আল্লাহর রহমতের আশা

আশা।

২- আশা:

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন- সহজ করো, কঠিন করো না; সুসংবাদ দাও, (হতাশ করে) দূরে সরিয়ে দিও না। (-বুখারী)

ব্যাখ্যা:

আশা বলা হয়-

আল্লাহর অস্তিত্ব, অনুগ্রহ ও দয়াকে উপলব্ধি করা ও তাঁর দয়া ও অনুগ্রহের কথা মনে করে আনন্দিত হওয়া এবং এ বিষয়ে তাঁর উপর পূর্ণ ভরসা ও আস্থা রাখা। আশা মানুষের কলবকে আল্লাহ এবং জান্নাতের দিকে নিয়ে যায়। মহান আল্লাহ বলেন:{যে গোনাহ করে কিংবা নিজের অনিষ্ট করে, অতঃপর আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে, সে আল্লাহকে ক্ষমাশীল, করুণাময় পায়।}[সূরা: আন-নিসা, আয়াত:১১০]

প্রকারভেদ:

আশা তিন প্রকার। দুটি ইতিবাচক এবং একটি নেতিবাচক ও গর্হিত।

১- আল্লাহর প্রত্যাদেশ অনুযায়ী তাঁর আনুগত্য করে সাওয়াবের প্রত্যাশা করা।

২- কেউ গুনাহ করে তাওবা করল এবং আল্লাহ তাকে মাফ করে দিবেন, তার গুনাহ মিটিয়ে দিবেন, ক্ষমা করে দিবেন ও তার গুনাহকে ঢেকে রাখবেন মর্মে আশা করা।

৩- কোন ব্যক্তি সীমালঙ্ঘন, পাপ ও গুনাহ অব্যাহতবাবে করতে থাকল এবং আল্লাহর রহমত ও মাফের আশা করল। এটা একটি ধোঁকা এবং মিথ্যা আশা। এমন আশার কোনই মূল্য নেই। মুমিনের আশা, আমলের দ্বারা পূর্ণ হয়ে থাকে। মহান আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন-{আর এতে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই যে, যারা ঈমান এনেছে এবং যারা হিজরত করেছে আর আল্লাহর পথে লড়াই (জেহাদ) করেছে, তারা আল্লাহর রহমতের প্রত্যাশী। আর আল্লাহ হচ্ছেন ক্ষমাকারী করুনাময়।}
[সূরা: আল-বাক্বারাহ, আয়াত:২১৮।]

আশার স্তরসমূহ

আশার অনেক স্তর রয়েছে। যার একটি অপরটি থেকে উন্নত। এই স্তরসমূহ হলো-

১- এমন আশা যা ইবাদাতে মগ্ন হতে উৎসাহিত করে। ইবাদাতকে তার কাছে উপভোগ্য করে তোলে। যদিও সে ইবাদাত কঠিন ও কষ্টসাধ্য হয়। এ আশা তাকে গুনাহ ও গর্হিত কাজ থেকেও বিরত রাখবে।

২- আল্লাহকে পাওয়ার সাধনায় রত ব্যক্তিদের আশা। যা তারা কূ-প্রবৃত্তির চাহিদাসমূহ পরিত্যাগ এবং তাদের সৃষ্টিকর্তার পছন্দনীয় বিষয়সমূহের জন্য বাধাগ্রস্ত হয় এমন কাজকে পরিত্যাগ করার মাধ্যমে করে থাকে। যাতে তাদের কলব আল্লাহর জন্য একনিষ্ঠ হয়ে যায়।

৩- বিশিষ্ট বান্দাগণের আশা: পুনরুত্থানকারী মহান স্রষ্টার সাথে মিলিত হওয়ার আশা করা, তাঁর সঙ্গে সাক্ষাত লাভের জন্য ব্যাকুল থাকা এবং অন্তরজুড়ে একমাত্র আল্লাহর দীদার লাভের প্রবল ইচ্ছা থাকা। আশার প্রকারসমূহের মধ্যে এটা হচ্ছে সর্বোত্তম ও সর্বোচ্চ মর্যাদার। আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন-{অতএব, যে ব্যক্তি তার পালনকর্তার সাক্ষাত কামনা করে, সে যেন, সৎকর্ম সম্পাদন করে এবং তার পালনকর্তার এবাদতে কাউকে শরীক না করে।}[সূরা: আল-কাহাফ, আয়াত:১১০।]

আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন- {যে আল্লাহর সাক্ষাত কামনা করে, আল্লাহর সেই নির্ধারিত কাল অবশ্যই আসবে। তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞানী।}
[সূরা: আল-আনকাবুত, আয়াত:৫]

যে ব্যক্তি কোনকিছুর আশা করে সে তা পেতে চেষ্টা করে।

আল্লাহ ও তাঁর নাম ও গুণাবলীর সঙ্গে আশার সম্পর্ক:

যে ব্যক্তি আল্লাহর কাছে উপরোল্লেখিত কোন প্রকারের আশা পোষন করে, সে নিরবিচ্ছিন্নভাবে আল্লাহর আনুগত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত ও ঈমানের দাবীর উপর অটল থাকে। সে আল্লাহর কাছে আশা করে যে, আল্লাহ তাকে বক্র করবেন না। তার আমলসমূহ ফিরিয়ে না দিয়ে কবুল করে নিবেন। তার সাওয়াব ও প্রতিদান বৃদ্ধি করে দিবেন। সে আল্লাহর অনুগ্রহের আশায় সাধ্যমতো সব চেষ্টাই করে। আল্লাহর পরিচয়, তাঁর নামসমূহ এবং গুণাবলী সম্পর্কে অবহিত হওয়ার কারণে সে জানে যে আল্লাহ তার সাথে দয়ার্দ্র, ক্ষমাশীল, দানশীল ও মায়াবী আচরণ করবেন। তিনি পুরো দুনিয়ার জন্যই দয়ালু। তিনি সকলকে নিরাপত্তা দান করবেন।

আশার ফলাফল:

১- যে ব্যক্তি আল্লাহর প্রতি আশা রাখে সে আনুগত্য ও আমল বৃদ্ধি করার চেষ্টা অব্যাহত রাখে।

২- এমন ব্যক্তির আনুগত্য নিরবিচ্ছিন্ন হয়ে থাকে। অবস্থার পরিবর্তন বা প্রতিকূলতা তার পথচলাকে ব্যহত করতে পারে না।

৩- এমন ব্যক্তি সর্বদা আল্লাহর নৈকট্য লাভের প্রতি মনোযোগী থাকে। তার মাঝে থাকে আল্লাহর কাছে মুনাজাতের প্রচণ্ড বাসনা। সে নম্রতা ও মিনতি নিয়ে তাঁর কাছে প্রার্থনা করে।

৪- তার মধ্যে পরিপূর্ণ দাসত্ব প্রকাশ পায়। অভাব ও প্রয়োজন পূরণের ভার সে পুরোপুরি রবের উপর সোপর্দ করে। সে এক মহূর্তও নিজেকে আল্লাহর অনুগ্রহ ও দয়ার অমুখাপেক্ষী মনে করে না।

৫- আল্লাহর অস্তিত্ব ও অনুগ্রহের উপর তার পরিপূর্ণ আস্থা সৃষ্টি হয় এবং এ বিশ্বাস সৃষ্টি হয়- যে তাঁর কাছে প্রার্থনা করে, অথবা তাঁর রাহে দান করে, তার জন্য তিনি অধিক দানশীল। তিনি চান বান্দা তাঁর নিকট প্রার্থনা করবে, আশা করবে এবং বারবার আশা করতেই থাকবে।

৬- আশা বান্দাকে আল্লাহর মুহাব্বতের চৌকাঠে নিয়ে ফেলে। তাকে মুহাব্বতের পরাকাষ্ঠায় নিয়ে যায়। অতঃপর যখনই তার আশা তীব্র হয়, সে যা আশা করে তা লাভ করে। তখন রবের প্রতি তার ভালবাসা, কৃতজ্ঞতা এবং সন্তুষ্টি বৃদ্ধি পায়। আর এটাই বন্দেগী ও দাসত্বের মূল দাবী বা ভিত্তি।

আশা পোষণকারী ব্যক্তি সর্বদা আগ্রহী, ভীত এবং তার রবের অনুগ্রহের প্রত্যাশী হয়। আল্লাহর প্রতি তার উত্তম ধারণা সৃষ্টি হয়। মুমিনব্যক্তি তার রবের প্রতি সুধারণা পোষণ করে। তার আমল হয় অত্যন্ত সুন্দর। আর পাপাচারী ব্যক্তি তার রবের প্রতি মন্দ ধারণা পোষণ করে বিধায় তার আমলও হয় খারাপ। যে ব্যক্তি আল্লাহর প্রতি সুধারণা পোষণ করে সে বিশ্বাস করে, তাঁর কাছে আশ্রয় গ্রহণকারী ব্যক্তিকে আল্লাহ তা'আলা ধ্বংস করবেন না।

৭- আশা মানুষকে কৃতজ্ঞতার সোপানে নিয়ে যায়। কেননা আশা তাকে কৃতজ্ঞতা প্রকাশে উদ্বুদ্ধ করে। আর এটাই হলো গোলামী ও দাসত্বের সারমর্ম।

৮- আশা বান্দাকে আল্লাহর নাম এবং গুণাবলীর সাথে পরিচয় করিয়ে দেয় যে, তিনি মহান দয়ালু, সম্মানিত, দোয়া কবুলকারী, সুন্দর, অমুখাপেক্ষী। তিনি মহান পবিত্রতার অধিকারী।

৯- আল্লাহর প্রতি আশা মানুষের কামনা-বাসনা পূর্ণ হওয়ার উপায়। আর কাঙ্খিত বাসনা পূর্ণ হওয়ার ফলে বান্দা আরো বেশি দু'আর প্রতি প্রলুব্ধ ও আল্লাহর দিকে মনোযোগী হয়। এমনিভাবে বান্দার ঈমান বৃদ্ধি হতে থাকে এবং সে দয়াময়ের নিকটবর্তী হতে থাকে।

১০- কিয়ামতের দিন মুমিনগন আল্লাহর সন্তুষ্টি, জান্নাত ও প্রতিপালকের দর্শন ইত্যাদি নেয়ামত লাভের মাধ্যমে যখন নিজের আজীবনের লালিত আশার প্রতিফলন দেখতে পাবে, তখন সে উল্লাসিত হবে। আর এসব অর্জন হবে আল্লাহর প্রতি বান্দার আশা ও ভয়ের অনুপাতে।

আশা সংক্রান্ত কতিপয় জ্ঞাতব্য:

১- মুমিনের জন্য আশা পোষণ করার পাশাপাশি ভয়ও পোষন করা জরুরী এবং আল্লাহর প্রতি ভয়ের ক্ষেত্রেও পাশাপাশি আশা পোষন অত্যাবশ্যকীয়। সুতরাং যে ক্ষেত্রে আশা পোষণ করা উচিত সেখানে ভয়ও থাকতে হবে: আল্লাহ তা'আলা বলেন:{তোমাদের কি হল যে, তোমরা আল্লাহ তা’আলার শ্রেষ্টত্ব আশা করছ না।}
[সূরা: নূহ, আয়াত: ১৩]

মহান আল্লাহ তা'আলা বলেছেন: {মুমিনদেরকে বলুন, তারা যেন তাদেরকে ক্ষমা করে, যারা আল্লাহর সে দিনগুলো সম্পর্কে বিশ্বাস রাখে না} [সূরা: আল-জাছিয়া, আয়াত: ১৪]

অর্থাৎ তাদের পূর্ববর্তীদের উপর যেমন ধ্বংসাত্মক আজাব অবতীর্ণ হয়েছিল তেমন আজাব তাদের উপর আপতিত হওয়াকে তারা ভয় করে না।

২- আশা হচ্ছে এমন ঔষধ, প্রতি মুহূর্তেই আমরা তার মুখাপেক্ষী:

নফসের উপর যখন নিরাশা ভর করে তখন ইবাদাত থেকে মন উঠে যায়।

ব্যক্তির উপর ভয় যখন অতিমাত্রায় প্রভাব বিস্তার করে, তখন তার ও তার পরিবারের জন্য অনেক ক্ষেত্রে ক্ষতিকর বলে প্রমাণিত হয়। অতঃপর তার এই ভয় একপর্যায়ে শরীয়তের কাঙ্খিত সীমা লঙ্ঘন করে। সে ক্ষেত্রে যে বিষয়টি তাকে ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থানে নিয়ে আসবে, সেটি অবলম্বন করা উচিত। আর তা হচ্ছে আশা। আশা হলো মুমিনের স্বভাবজাত বিষয়।

৩- আশা হলো নিরাশার বিপরীত। নিরাশা আল্লাহর রহমত সম্পর্কে হতাশা সৃষ্টি করে এবং আল্লাহর কাছে অনুগ্রহের আশা করা থেকে মনকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। এটা গোমরাহী ও কুফরীর কারণ। আল্লাহ তা'আলা বলেন: {এবং আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয় আল্লাহর রহমত থেকে কাফের সম্প্রদায় ব্যতীত অন্য কেউ নিরাশ হয় না।}[সূরা: ইউসুফ, আয়াত: ৮৭।]

যদি কোন পাল্লা দিয়ে খাঁটি মুমিনের ভয় এবং আশা পরিমাপ করা হয় তবে তা সমান সমান পাওয়া যাবে। কতই না ভালো হতো আমার হিসাব যদি আমার পিতার কাছে দেয়া হতো! আর আমার স্রষ্টা আমার পিতা হতে উত্তম।

-ইমাম সুফিয়ান সাওরী।

ভয় এবং আশা ব্যতীত ইবাদাত পরিপূর্ণ হবে না। ভয় অশ্লীল কাজ থেকে বিরত রাখে আর আশা দ্বারা আনুগত্য বৃদ্ধি পায়।

-ইমাম ইবনে কাসির।



Tags: