আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাত হবে-এবিষয়ে ঈমান

আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাত হবে-এবিষয়ে ঈমান

আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাত হবে-এবিষয়ে ঈমান..

সকলকে আল্লাহর নিকট ফিরে যেতে হবে। তিনিই সবার শেষ ঠিকানা ও প্রর্তাবর্তনস্থল। এটা আল্লাহর প্রতি ঈমানের একটি মৌলিক পয়েন্ট, বরং ঈমানের অন্যতম রোকন বা স্তম্ভ। সুতরাং ঈমানের স্তম্ভ সমূহের মধ্যে একটি হলো আখেরাতের উপর ঈমান আনা। বিশুদ্ধ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, যখন জিব্রীল আ: সাহাবীদের সম্মুখে আমাদের নবীকে শিক্ষক হিসেবে ঈমানের রোকন সম্পর্কে প্রশ্ন করলেন, তখন তিনি বলেছিলেন:«ঈমান হলো, তুমি- আল্লাহ, ফেরেশতাগণ, আল্লাহর কিতাব সমূহ, রাসুলগণ এবং পরকাল ও আল্লাহর পক্ষ হতে তাকদীরের ভালমন্দে বিশ্বাস করবে।» (হাদীসটি বর্ণনা করেছেন ইমাম মুসলিম।)

আর পরকালকে 'ইয়াউমুল আখেরাহ' বা শেষ দিবস বলা হয় এজন্য যে, সেদিনের পর আর কোন দিন থাকবে না। এরপরই জান্নাতী জান্নাতে ও জাহান্নামীরা জাহান্নামে স্থায়ীভাবে বসবাস করবে। এই দিবসের অনেকগুলো নাম বর্ণিত হয়েছে কুরআনুল কারীমে। সেসব নাম দিনটি ও তাতে সংঘটিত হওয়া ঘটনাবলীর মাহত্ম বহন করে। পরকালের যে কয়েকটি নাম কুরআনে এসেছে তম্মধ্যে একটি হলো, 'ঘটনার সংঘটিত দিন', এনামে নাম করণের কারণ হলো, আলোচিত ঘটনাটি নিশ্চিতরূপে ঘটবে। আরেকটি হলো, 'অবনমনকারী ও উত্তোলনকারী'। এনামে নামকরণের কারণ হলো, সেদিনটি অনেক লোককে জান্নাতে উন্নীত করবে আবার অনেককে জাহান্নামে অবতীর্ণ করবে। আরেকটি নাম হলো, 'ইয়াউমুল হিছাব, ওয়াল জাযা ওয়াদ্দীন' অর্থাৎ হিসাব-নিকাশ ও প্রতিদান দিবস। 'ইয়াউমুল হা-ক্কাহ' বা সত্য সংঘটনের দিনও বলা হয়। কারণ, এদিনে আল্লাহর প্রদান করা সংবাদ সমূহ সত্য প্রমাণ হবে। এদিনকে 'তা-ম্মাহ'ও বলা হয়, যার অর্থ মহাবিপর্যয়ের দিন। 'ছা-খ্খাহ'ও বলা হয়। এর অর্থ হলো বিকট শব্দ। কেননা, এদিনের প্রারম্ভে সিঙ্গায় ফুঁৎকার দেওয়ার ফলে বিকট শব্দের সৃষ্টি হবে। এটাকে 'ইয়াউমুল ওয়াঈদ' বা হুমকির দিনও বলা হয়। কেননা এদিনে কাফেরদের জন্য কৃত আল্লাহর হুমকি সমূহ বাস্তবায়িত হবে। আরেকটি নাম হলো, 'ইয়াউমুল হাসরাহ' বা আক্ষেপের দিবস। 'ইয়াউমুত তালাক' বা সাক্ষাতের দিবসও বলা হয়। কারণ এদিনে সব মানুষ একই জায়গায় একত্রিত হবে। এটাকে 'ইয়াউমুল আ-যিফাহ' বলা হয়। কারণ সেদিনটি অতি সন্নিকটে। 'ইয়াউমুত তানাদ' বা একে অন্যকে আহবান করার দিনও বলা হয়। কেননা, এমনটি সেদিন ঘটবে। জান্নাতীরা জাহান্নামীদের ডাকবে এবং জাহান্নামীরা জান্নাতীদেরকে ডাকবে। এটাকে 'ইয়াউমুল আক্বীম'ও বলা হয়। কেননা সেটাই হবে সর্বশেষ দিন। তারপর আর কোন দিনের অস্তিত্ব থাকবে না। এছাড়াও সেদিনকে 'দারুল আখেরাহ' 'দারুল কারার' ও 'গাশিয়াহ' ইত্যাদিও বলা হয়।

আখেরাতের উপর ঈমান আনা বলতে কয়েকটি বিষয় বুঝায়:

প্রথমত: মৃত্যু পরবর্তী জীবনকে বিশ্বাস করা

কবরের মহা পরিক্ষা..

মৃতব্যক্তিকে দাফনের পর তার রব, দ্বীন ও নবী সম্পর্কে প্রশ্নের মাধ্যমে পরীক্ষা নেয়া হবে। তখন আল্লাহ তা'আলা ঈমানদারদেরকে সঠিক উত্তর দেয়ার তাওফীক দিবেন। সে উত্তরে বলবে, আমার রব আল্লাহ, আমার দ্বীন ইসলাম এবং আমার নবী মুহাম্মাদ সা.। আর অবাধ্যদের বিভ্রান্তির উপরই রাখবেন। সুতরাং কাফের বলবে, হায়! হায়! আমার তো কিছুই জানা নাই। অপরদিকে কপট ও সংশয়পোষণকারী বলবে, আমার জানা নেই, মানুষ কিছু একটা বলত, আমি তার স্বীকৃতি দিয়েছিলাম।

কবরের আজাব ও নেয়ামত:

কবরের শাস্তি হচ্ছে অবাধ্য, কপট, কাফের ও কতিপয় গুনাহগার মুমিনের জন্য। আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেছেন- {ঐ ব্যক্তির চাইতে বড় জালেম কে হবে, যে আল্লাহর প্রতি মিথ্যা আরোপ করে অথবা বলে: আমার প্রতি ওহী অবতীর্ণ হয়েছে। অথচ তার প্রতি কোন ওহী আসেনি এবং যে দাবী করে যে, আমিও নাযিল করে দেখাচ্ছি যেমন আল্লাহ নাযিল করেছেন। যদি আপনি দেখেন যখন জালেমরা মৃত্যু যন্ত্রণায় থাকে এবং ফেরেশতারা স্বীয় হস্ত প্রসারিত করে বলে, বের কর স্বীয় আত্মা! অদ্য তোমাদেরকে অবমাননাকর শাস্তি প্রদান করা হবে। কারণ, তোমরা আল্লাহর উপর অসত্য বলতে এবং তাঁর আয়াত সমূহ থেকে অহংকার করতে।}(সূরা: আল-আন’আম, আয়াত: ৯৩-)

আল্লাহ তা'আলা ফেরাউনের অনুগতদের উদ্দেশ্যে বলেছেন-{সকালে ও সন্ধ্যায় তাদেরকে আগুনের সামনে পেশ করা হয় এবং যেদিন কেয়ামত সংঘটিত হবে, সেদিন আদেশ করা হবে, ফেরাউন গোত্রকে কঠিনতর আযাবে দাখিল কর।}
[সূরা: আল মুমিন, আয়াত: ৪৬]

জায়েদ বিন সাবিত রা. হযরত নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন- «যদি এমন আশঙ্কা না করতাম যে তোমরা দাফন করা ছেড়ে দিবে তবে আল্লাহ তা'আলার কাছে দোয়া করতাম যেন তিনি তোমাদেরকে কবরের আজাবের আওয়াজ শুনিয়ে দেন, যা আমি শুনতে পাই। এরপর তিনি আমাদের দিকে মুখ করে বললেন, 'তোমরা আল্লাহ তা'আলার কাছে কবরের আজাব থেকে আশ্রয় প্রার্থনা কর।’তখন আমরা বললাম, আমরা আল্লাহ তা'আলার কাছে কবরের আজাব থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছি। অতপর তিনি বললেন, 'তোমরা আল্লাহ তা'আলার কাছে জাহান্নাম থেকে আশ্রয় প্রার্থনা কর।’আমরা বললাম, আমরা জাহান্নাম থেকে আল্লাহ তা'আলার আশ্রয় প্রার্থনা করছি। এরপর তিনি বললেন, 'তোমরা আল্লাহ তা'আলার কাছে প্রকাশ্য অপ্রকাশ্য ফেতনা থেকে পানাহ চাও।’ আমরা বললাম, আমরা আল্লাহ তা'আলার কাছে প্রকাশ্য অপ্রকাশ্য ফেতনা থেকে পানাহ চাচ্ছি।» (-মুসলিম শরীফ।)

কবরের নেয়ামতসমূহ সৎকর্মপরায়ণ মুমিনদের জন্য। আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেছেন-{নিশ্চয় যারা বলে, আমাদের পালনকর্তা আল্লাহ, অতঃপর তাতেই অবিচল থাকে, তাদের কাছে ফেরেশতা অবতীর্ণ হয় এবং বলে, তোমরা ভয় করো না, চিন্তা করো না এবং তোমাদের প্রতিশ্রুত জান্নাতের সুসংবাদ শোন।}
[সূরা: ফুসসিলাত (হামীম সেজদাহ); আয়াত: ৩০]

আল্লাহ তা'আলা বলেছেন:{অতঃপর যখন কারও প্রাণ কন্ঠাগত হয়। এবং তোমরা তাকিয়ে থাক, তখন আমি তোমাদের অপেক্ষা তার অধিক নিকটে থাকি; কিন্তু তোমরা দেখ না। যদি তোমাদের হিসাব-কিতাব না হওয়াই ঠিক হয়, তবে তোমরা এই আত্মাকে ফিরাও না কেন, যদি তোমরা সত্যবাদী হও ? যদি সে নৈকট্যশীলদের একজন হয়; তবে তার জন্যে আছে সুখ, উত্তম রিযিক এবং নেয়ামতে ভরা উদ্যান। আর যদি সে ডান পার্শ্বস্থদের একজন হয়, তবে তাকে বলা হবে: তোমার জন্যে ডানপার্শ্বসস্থদের পক্ষ থেকে সালাম। আর যদি সে পথভ্রষ্ট মিথ্যারোপকারীদের একজন হয়, তবে তার আপ্যায়ন হবে উত্তপ্ত পানি দ্বারা। এবং সে নিক্ষিপ্ত হবে অগ্নিতে। এটা ধ্রুব সত্য। অতএব, আপনি আপনার মহান পালনকর্তার নামে পবিত্রতা ঘোষণা করুন।}[সূরা: আল ওয়াকিয়াহ, আয়াত: ৮৩- ৯৬]

মুমিন যখন কবরে দু ফেরেশতার প্রশ্নের উত্তর দিবে সে সম্পর্কে হযরত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-«আসমান থেকে একজন আহ্বানকারী ডেকে বলবেন, যদি আমার বান্দা সত্য বলে থাকে তবে তাকে জান্নাতের বিছানা বিছিয়ে দাও। জান্নাতী পোশাক পরিধান করিয়ে দাও। তার কবর থেকে জান্নাতের দিকে একটি দরজা খুলে দাও। অতঃপর জান্নাত থেকে তার কবরে প্রশান্তিময় সুবাতাস বইতে শুরু করবে। এবং তার কবরকে দৃষ্টির শেষসীমা পর্যন্ত প্রসারিত করে দেয়া হবে।» (-আবুদাউদ, আহমদ।)

দ্বিতীয়ত: মৃত্যু পরবর্তী পুনরুত্থানে বিশ্বাস:

যখন দ্বিতীয়বার শিংগায় ফুঁৎকার দেয়া হবে তখন সকল মৃতকে জীবিত করা হবে। মানুষ সমগ্র জাহানের প্রতিপালকের সামনে দাঁড়াবে। খালি পা, নাঙা শরীর এবং খাতনাবিহীন অবস্থায় সে পুনরুত্থিত হবে। আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেছেন-{যেভাবে আমি প্রথমবার সৃষ্টি করেছিলাম, সেভাবে পুনরায় সৃষ্টি করব। আমার ওয়াদা নিশ্চিত, আমাকে তা পূর্ণ করতেই হবে।}
[সূরা: আম্বিয়া, আয়াত: ১০৪]

পূনর্জীবন একটি প্রমাণিত সত্য বিষয়। কোরআন ও সুন্নায় এ বিষয়ে সুস্পষ্ট বর্ণনা রয়েছে। সকল মুসলিমও এ বিষয়ে একমত। আল্লাহ তা'আলা বলেন:
{এরপর তোমরা মৃত্যুবরণ করবে অতঃপর কেয়ামতের দিন তোমরা পুনরুত্থিত হবে।}

[সূরা: আল-মুমিনুন, আয়াত: ১৫- ১৬]

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:«কেয়ামতের দিন মানুষকে খাতনাবিহীন নাঙা বদনে একত্রিত করা হবে।» (-বোখারী ও মুসলিম।)

মুসলমানগণ পরকালের ব্যাপারে একমত। প্রজ্ঞাপূর্ণ বিবেচনার দাবীও এটাই যে, আল্লাহ তা'আলা তাঁর সৃষ্টিকে পরকালে একত্রিত করবেন। যেখানে প্রত্যেককে তার দায়িত্বের ব্যাপারে জবাবদিহি করতে হবে এবং প্রাপ্ত বিনিময় ভোগ করতে হবে। সকল নবীই এ বিষয়টি নিশ্চিত করে গেছেন। আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেছেন:{তোমরা কি ধারণা কর যে, আমি তোমাদেরকে অনর্থক সৃষ্টি করেছি এবং তোমরা আমার কাছে ফিরে আসবে না?}[সূরা: আল-মুমিনুন, আয়াত: ১১৫]

আল্লাহ তা'আলা তাঁর নবীকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন:{যে আল্লাহ আপনার প্রতি কুরআন বিধিবদ্ধ করেছেন, তিনি অবশ্যই আপনাকে মূলভূমিতে ফিরিয়ে আনবেন।}[সূরা: আল কাসাস, আয়াত: ৮৫]

হযরত উসমান রা. যখন কবরের পাশে দাড়াতেন তখন এত ক্রন্দন করতেন যে তার দাড়ি ভিজে যেত। বর্ণনাকারী বলেন, তাকে জিজ্ঞেস করা হলো, জান্নাত ও জাহান্নামের কথা আলোচনা হলে আপনি ক্রন্দন করেন না অথচ কবরের পাশে আসলে আপনি ক্রন্দন করেন। উত্তরে তিনি বলেন, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন 'নিশ্চয়ই পরকালীন ঘাটিসমূহের মধ্যে কবর হচ্ছে প্রথম ঘাটি। যদি কেউ এখানে মুক্তি পায় তবে পরবর্তী ধাপগুলো তার জন্যে সহজ হবে। আর এখানে যদি মুক্তি না পায় তবে পরবর্তীতে সে আরো বিপদে পড়বে।' তিনি আরো বলেন, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আমি কবর অপেক্ষা অধিক ভয়ানক কোন স্থান দেখিনি। -আহমদ।

তৃতীয়ত: কিয়ামতের আলামত ও নিদর্শনাবলীর উপর বিশ্বাস স্থাপন করা।

এ নিদর্শনাবলী কিয়ামতের পূর্বে সংঘটিত হবে। যা কিয়ামত নিকটবর্তী হওয়ার জানান দিবে। এ সকল নিদর্শনকে 'ছুগরা' ও 'কুবরা' (ছোট আলামত ও বড় আলামত) নামে ভাগ করা হয়েছে।

আলামাতে ছুগরা বা ছোট আলামত:

এমন সব আলামত যা কিয়ামতের পূর্বে সংঘটিত হবে। এর বেশিরভাগ কেয়ামতের বেশ পূর্বেই দেখা দিবে। ইতিমধ্যেই আলামতে ছুগরার কিছু কিছু সংঘটিত হয়ে গেছে এবং কোন কোন ক্ষেত্রে পুনর্বার সংঘটিত হবে। আর কিছু সংঘটিত হয়ে গেছে এবং এখনো তা চলমান এবং পালাক্রমে সংঘটিত হয়েই চলেছে। আর কিছু এখনো সংঘটিত হয়নি। তবে কিয়ামতের পূর্বে অবশ্যই সংঘটিত হবে। হযরত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমনই বলে গেছেন। যেমন- নবী হিসাবে তাঁর আগমন ও ইন্তেকাল, বাইতুল মুকাদ্দাস বিজয়, নানারকমের ফেতনার আবির্ভাব, আমানতে খেয়ানত করা, ইলম উঠে মূর্খতার সয়লাব হওয়া, ব্যভিচার ও সুদের প্রসার ঘটা, বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার ব্যপক হওয়া, মদ্যপান বেড়ে যাওয়া, বকরীর রাখালের মত নিম্নশ্রেণীর লোকেরা সুউচ্চ ভবনের অধিকারী হওয়া, পিতামাতার অবাধ্য হওয়া, তাদের সাথে দাসীর মত আচরণ করা, হত্যাকাণ্ড বেড়ে যাওয়া, ভূমিধ্বস, ভূমিকম্প ও রূপবিকৃতি বেড়ে যাওয়া, মিথ্যাসাক্ষ্য ও শপথ এবং উলঙ্গপনা বেড়ে যাওয়া, সত্যকে গোপন করার প্রবণতা বৃদ্ধি পাওয়া ইত্যাদি যা কোরআন ও সুন্নাহ-এর মাঝে বর্ণনা করা হয়েছে।

আলামতে কুবরা বা বড় আলামত:

এমন সব বৃহত্তর বিষয় যেগুলোর সংঘটিত হওয়া কিয়ামত সন্নিকটবর্তী হওয়াকে নিশ্চিত করবে। এমন আলামত দশটি। যথা- দাজ্জালের আবির্ভাব, ঈসা আ.-এর আগমন, ইয়াজুজ মাজুজের উদ্ভব। তিনটি বড় ধরনের ভূমিধ্বস- পূর্বে, পশ্চিমে ও আরব উপদ্বীপে। তীব্র ধোঁয়া সৃষ্টি হওয়া, সূর্য পশ্চিম দিক থেকে উঠা, এবং বিশেষ একটি জন্তুর আবির্ভাব ঘটা। এমন আগ্নেয়গিরি সৃষ্টি হওয়া যা মানুষকে হাশরের ময়দানের দিকে হাঁকিয়ে নিয়ে যাবে। এই আলামতগুলো ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশ পাবে। এর একটি প্রকাশ পাওয়ার পরই অপরটি প্রকাশ পাবে।

চতুর্থত: কিয়ামতের ভয়াবহতার উপর বিশ্বাস:

১- পাহাড়সমূহ প্রচণ্ডভাবে কেঁপে উঠবে এবং মাটিতে পরিণত হয়ে সাধারণ জমীনের সাথে মিশে যাবে।

আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেছেন:{তুমি পর্বতমালাকে দেখে অচল মনে কর, অথচ সেদিন এগুলো মেঘমালার মত চলমান হবে।}[সূরা: আন-নামল, আয়াত: ৮৮]

আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেছেন:{এবং পর্বতমালা ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাবে। অতঃপর তা হয়ে যাবে উৎক্ষিপ্ত ধূলিকণা।}[সূরা: আল-ওয়াকিয়াহ, আয়াত: ৫- ৬]

আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেছেন:{এবং পর্বতসমূহ হবে রঙ্গীন পশমের মত}
[সূরা: আল মায়ারিজ, আয়াত: ৯]

আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেছেন:{তারা আপনাকে পাহাড় সম্পর্কে প্রশ্ন করে। অতএব, আপনি বলুন: আমার পালনকর্তা পাহাড়সমূহকে সমূলে উৎপাটন করে বিক্ষিপ্ত করে দিবেন। অতঃপর পৃথিবীকে মসৃণ সমতলভূমি করে ছাড়বেন। তুমি তাতে মোড় ও টিলা দেখবে না}[সূরা: তাহা, আয়াত: ১০৫- ১০৭]

২- সাগরগুলো উত্তপ্ত হয়ে বিস্ফোরিত হবে, টগবগ করে জ্বলতে থাকবে। ধরাপৃষ্ঠের বহুলাংশ জুড়ে যে সমুদ্র রয়েছে, সেদিন তাতে আগ্নেয়গিরি মহাবিস্ফোরণ সৃষ্টি হবে। আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন-{যখন সমুদ্র বিস্ফোরিত হবে।}
[সূরা: আল-ইনফিতার, আয়াত: ৩]{যখন সমুদ্রকে উত্তাল করে তোলা হবে}
[সূরা: আত-তাকভীর, আয়াত: ৬]

৩- মানুষ যে মাটিতে আশ্রয় নিয়ে আছে তা বদলে যাবে। একই দশা হবে আসমানের। অত:পর মানবজাতিকে পূনরায় উত্থিত করা হবে এমন ভূমিতে যা যেন তারা কখনো দেখেনি।

আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেছেন:{যেদিন পরিবর্তিত করা হবে এ পৃথিবীকে অন্য পৃথিবীতে এবং পরিবর্তিত করা হবে আকাশ সমূহকে এবং লোকেরা পরাক্রমশালী এবং আল্লাহর সামনে পেশ হবে।}[সূরা: ইবরাহীম, আয়াত: ৪৮।]

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:«কিয়ামতের দিন মানুষ একটি স্বচ্ছ চেপটা রুটির মত সাদাপ্রান্তরে একত্রিত হবে। সেখানে কারো কোন প্রতীক বা চিহ্ন থাকবে না।» (-বোখারী ও মুসলিম।)

সুতরাং তা হয়ে যাবে প্রতীকহীন একটি শুভ্রপ্রান্তর।

৪- মানুষ এমন কিছু বিষয় প্রত্যক্ষ করবে যা পূর্বে দেখেনি। তারা সেখানে চাঁদ ও সূর্যকে একত্রিত দেখতে পাবে। ফলে মানুষের উদ্বেগ উৎকণ্ঠা বেড়ে যাবে। আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন:{যখন দৃষ্টি চমকে যাবে, চন্দ্র জ্যোতিহীন হয়ে যাবে। এবং সূর্য ও চন্দ্রকে একত্রিত করা হবে- সে দিন মানুষ বলবে: পলায়নের জায়গা কোথায় ?}[সূরা: আল-কিয়ামাহ, আয়াত: ৭- ১০]

৫- শিঙ্গায় ফুঁক দেয়া হবে এবং তা হচ্ছে এই দুনিয়ার শেষ মুহূর্ত। নির্দিষ্ট দিন আসলেই শিঙ্গায় ফুঁক দেয়া হবে। এই ফুঁক আসমান ও জমীনের সকল জীবনের সমাপ্তি ঘটাবে। আল্লাহ তা'আলা বলেন:{শিঙ্গায় ফুঁক দেয়া হবে, ফলে আসমান ও যমীনে যারা আছে সবাই বেহুঁশ হয়ে যাবে, তবে আল্লাহ যাকে ইচ্ছা করেন সে ব্যতিক্রম থাকবে।} (সূরা: জুমার, আয়াত: ৬৮)

এই ফুঁৎকার মহাধ্বংসযজ্ঞ সৃষ্টি করবে, প্রত্যেক মানব সদস্যই তা শুনতে পাবে। তখন আর কেউ কোন ওসিয়ত করতেও সক্ষম হবে না। সে তার বন্ধু বা স্বজনের কাছেও ফিরতে পারবে না। আল্লাহ তা'আলা বলেন:{তারা কেবল একটা ভয়াবহ শব্দের অপেক্ষা করছে, যা তাদেরকে আঘাত করবে তাদের পারস্পরিক বাকবিতন্ডাকালে। তখন তারা ওছিয়ত করতেও সক্ষম হবে না। এবং তাদের পরিবার-পরিজনের কাছেও ফিরে যেতে পারবে না।}[সূরা: ইয়াসিন, আয়াত: ৪৯- ৫০]

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন: «অতঃপর শিঙ্গায় ফুঁৎকার দেয়া হবে এবং এই বিকট আওয়াজ যে শুনবে সে একবার ঘাড় নিচে নোয়াবে এবং একবার উপরে উঠাবে। বর্ণনাকারী বলেন, প্রথম এই আওয়াজ এমন ব্যক্তি শুনবে, যে তার উটকে পুকুরে গোসল করাতে পানি ঘোলাটে করছে। শিঙ্গার আওয়াজ শুনে সে বেহুশ হয়ে যাবে অতঃপর সবমানুষ বেহুশ হয়ে যাবে।» (-মুসলিম।)

৬- আল্লাহ তা'আলা সৃষ্টির শুরু থেকে কিয়ামত পর্যন্ত যত মাখলুক সৃষ্টি করবেন সবাই হাশরের ময়দানে একত্রিত হবে। মানুষ, জ্বিন, পশুপাখি সবকিছুই সেখানে একত্রিত হবে। আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন:{নিশ্চয় এর মধ্যে নিদর্শন রয়েছে এমন প্রতিটি মানুষের জন্য যে আখেরাতের আযাবকে ভয় করে। সেটা এমন এক দিন, যে দিন সব মানুষেই সমবেত হবে, সেদিনটি হবে হাযিরের দিন।}[সূরা: হুদ, আয়াত: ১০৩]

আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন-

{বলুন: পূর্ববর্তী ও পরবর্তীগণ, সবাই একত্রিত হবে এক নির্দিষ্ট দিনের নির্দিষ্ট সময়ে।}
[সূরা: আল-ওয়াকিয়াহ, আয়াত-৪৯- ৫০।]

৭- মানুষ বিবস্ত্র অবস্থায় হাশরের ময়দানে একত্রিত হবে। ভয়াবহ পরিস্থিতির কারণে সেদিকে কেউ ভ্রুক্ষেপ করবে না। উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়শা রা. এ বিষয়ে আশ্চর্যবোধ করেন। আয়শা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: «রাসূলুল্লাহ বললেন, হাশরের দিন মানুষকে নাঙ্গা পা, উলঙ্গ শরীর ও খাতনাবিহীন অবস্থায় একত্রিত করা হবে। (আয়শা বলেন-) আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! পুরুষ ও নারী কি একে অপরকে দেখতে থাকবে? তিনি বললেন- পরিস্থিতি এতোটা ভয়াবহ হবে যে, তাদের দেখাদেখির মানসিকতা থাকবে না।» (-বোখারী।)

৮- জালিমের জুলুমের বদলা নেয়া হবে। এমনকি পশুপাখির ক্ষেত্রেও বিচারের এই ব্যবস্থা কায়েম করা হবে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: «কিয়ামতের দিন তোমাদের অবশ্যই নিজ নিজ পাওনাদারের প্রাপ্য আদায় করতে হবে। এমনকি শিংবিহীন ছাগলের প্রাপ্য প্রতিশোধ শিংবিশিষ্ট ছাগল থেকে নেওয়া হবে।» (-মুসলিম।)

হযরত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: «তোমাদের মধ্যে যে কেউ তোমার ভাইয়ের সম্মান বা সম্পদের ক্ষেত্রে জুলুম করেছ, সে যেন যেদিন মানুষের কাছে দিরহাম দিনার থাকবে না সেদিন আসার পূর্বেই সমাধান করে নেয়। সেদিন জুলুমের বিপরীতে যার নেকী আছে তার থেকে নেকী নেয়া হবে। আর যার নেকী নেই মজলুমের গুনাহ তার উপর চাপানো হবে।» (-বোখারী।)

৯- হাশরের ময়দানে সূর্য মানুষের কাছাকাছি চলে আসবে। ফলে মানুষ তার আমল অনুযায়ী ঘামে হাবুডুবু খেতে থাকবে।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-

«কিয়ামতের দিন সূর্যকে মানুষের নিকটবর্তী করা হবে। এবং তা এক ‘মীল’ পরিমাণ তাদের নিকটবর্তী হবে। সুলাইম ইবনে আমের বলেন- আল্লাহর শপথ ‘মীল’এর দ্বারা কী উদ্দেশ্য নেওয়া হয়েছে, আমার জানা নাই। মীল বলতে জমীনের দূরত্ব (মাইল) নাকি (মীলের অপর অর্থ) ঐ সলাকা যা দ্বারা সুরমা লাগানো হয়। তিনি বলেন, অতঃপর মানুষ তাদের (পাপ কাজের) আমল অনুসারে ঘামের মধ্যে ডুবে থাকবে। তাদের মধ্যে কারো ঘাম পায়ের গোড়ালী পর্যন্ত হবে। কারো হাটু পর্যন্ত, কারো কোমর পর্যন্ত আবার কাউকে ঘাম পূর্ণ ঘ্রাস করে ফেলবে। বর্ণনাকারী বলেন, এ সময় হযরত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজ হাত দ্বারা মুখের দিকে ইশারা করেন।» (-মুসলিম।)

১০- কিছু লোকের আমলনামা ডান হাতে দেয়া হবে। আর কিছু লোকের আমলনামা বাম হাতে দেয়া হবে। মানুষ শঙ্কা, ভয় ও অস্থিরতার মধ্যে সময় কাটাবে। ইতোমধ্যে প্রত্যেককে তাদের হাতে আমলনামা দিতে থাকবে। যেসব মুমিন আমলনামা ডান হাতে পাবেন নাজাতের আশায় তারা প্রফুল্ল হবেন। আর কাফের ও মুনাফিকদের দুশ্চিন্তা বাড়তেই থাকবে, কারণ তারা আমলনামা বাম হাতে পেয়েছে। আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন-{অতঃপর যার আমলনামা ডান হাতে দেয়া হবে, সে বলবে: নাও, তোমরাও আমলনামা পড়ে দেখ। আমি জানতাম যে, আমাকে হিসাবের সম্মুখীন হতে হবে। অতঃপর সে সুখী জীবন-যাপন করবে, সুউচ্চ জান্নাতে। তার ফলসমূহ অবনমিত থাকবে। বিগত দিনে তোমরা যা প্রেরণ করেছিলে, তার প্রতিদানে তোমরা খাও এবং পান কর তৃপ্তি সহকারে। যার আমলনামা তার বাম হাতে দেয়া হবে, সে বলবে: হায় আমায় যদি আমার আমল নামা না দেয়া হতো। আমি যদি না জানতাম আমার হিসাব! হায়, আমার মৃত্যুই যদি শেষ হত। আমার ধন-সম্পদ আমার কোন উপকারে আসল না। আমার ক্ষমতাও বরবাদ হয়ে গেল।}[সূরা: আল-হাককাহ, আয়াত: ১৯- ২৯]

সেদিন মানুষ এতটা ভয় ও উৎকণ্ঠার মধ্যে থাকবে যে, কাছের কোন মানুষেরও খোঁজ কেউ নিবে না। আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন- {সেদিন সম্পদ ও সন্তান কোন কাজে আসবে না।}
[সূরা: আশ-শুরা, আয়াত: ৮৮]

আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন-{সেদিন পলায়ন করবে মানুষ তার ভ্রাতার কাছ থেকে, তার মাতা, তার পিতা, তার পত্নী ও তার সন্তানদের কাছ থেকে। সেদিন প্রত্যেকেরই নিজের এক চিন্তা থাকবে, যা তাকে ব্যতিব্যস্ত করে রাখবে।}
[সূরা: আবাসা, আয়াত:৩৪- ৩৭]

পঞ্চমত: হিসাবগ্রহণ ও প্রতিদানের প্রতি বিশ্বাস:

প্রতিটি মানুষের আমলের হিসাব দিতে হবে। এর প্রতিদান তাকে দেয়া হবে। আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন-{নিশ্চয় তাদের প্রত্যাবর্তন আমারই নিকট, অতঃপর তাদের হিসাব-নিকাশ আমারই দায়িত্ব।}[সূরা: আল-গাশিয়াহ, আয়াত:২৫- ২৬]

আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন-{যে একটি সৎকর্ম করবে, সে তার দশগুণ পাবে এবং যে, একটি মন্দ কাজ করবে, সে তার সমান শাস্তিই পাবে। বস্তুত: তাদের প্রতি জুলুম করা হবে না।}[সুরা: আল-আন’আম, আয়াত: ১৬০]

আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন-{আমি কেয়ামতের দিন ন্যায়বিচারের মানদন্ড স্থাপন করব। সুতরাং কারও প্রতি জুলুম হবে না। যদি কোন আমল সরিষার দানা পরিমাণও হয়, আমি তা উপস্থিত করব এবং হিসাব গ্রহণের জন্যে আমিই যথেষ্ট।}[সূরা: আল-আম্বিয়া, আয়াত: ৪৭]

হযরত ইবনে উমর রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

«নিশ্চয়ই আল্লাহ তা'আলা তাঁর এক মু’মিন বান্দাকে কাছে ডেকে নিবেন। অত:পর তার উপর আল্লাহর পর্দা রেখে তাকে আবৃত করা হবে। তখন আল্লাহ তা'আলা বলবেন, তুমি কি এই গুনাহ সম্পর্কে জান? তুমি কি এই গুনাহ সম্পর্কে জান? বান্দা বলবে, হে আমার প্রতিপালক! হ্যাঁ। যখন তার গুনাহ প্রমাণিত হয়ে যাবে এবং সে নিজের সর্বনাশ অবলোকন করতে শুরু করবে, তখন আল্লাহ তা'আলা বলবেন, আমি দুনিয়ায় তোমার এই পাপের কথা গোপন রেখেছিলাম। আর আজ এই গুনাহ ক্ষমা করে দিলাম। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, অতঃপর তাকে নেকীর হিসাবপত্র প্রদান করা হবে। আর কাফের ও মুনাফিকদের সকল মাখলুকের সামনে ডাকা হবে।» {এরাই ঐসব লোক, যারা তাদের পালনকর্তার প্রতি মিথ্যারোপ করেছিল। শুনে রাখ, যালেমদের উপর আল্লাহর অভিসম্পাত রয়েছে।}
[সূরা: হুদ, আয়াত: ১৮।](-বোখারী ও মুসলিম ।)

নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বিশুদ্ধ সূত্রে তাঁর রব সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে- «নিশ্চয়ই আল্লাহ তা'আলা নেকী ও গুনাহ উভয়টি লিপিবদ্ধ করেন। যদি কোন ব্যক্তি কোন নেক কাজের নিয়ত করে, পরবর্তীতে যদি সে ঐ নেক কাজ বাস্তবায়ন না করে তবুও আল্লাহ তা'আলার কাছে তার জন্য একটি নেকী লিপিবদ্ধ করা হয়। আর নেক কাজের নিয়ত করার পর তা যদি বাস্তবায়ন করে তবে দশ থেকে সত্তরটি বা তারও বেশি নেকী লেখা হয়। অপরদিকে কোন ব্যক্তি যদি কোন গুনাহর কাজের নিয়ত করে কিন্তু বাস্তবে সে গুনাহ না করে তবে তার জন্যও আল্লাহ তা'আলার কাছে একটি নেকী লিপিবদ্ধ করা হয়। আর যদি গুনাহর কাজ করেই ফেলে তবে আল্লাহ তা'আলা শুধু একটি গুনাহ লিপিবদ্ধ করান।» (-বোখারী ও মুসলিম।)

হাসান বসরী রাহ-কে উদ্দেশ্য করে বলা হলো, আমরা অনেক তাবেয়ীকে সাহাবীদের তুলনায় বেশী ইবাদাত করতে দেখেছি। তখন হযরত হাসান বসরী রহ. বললেন, তারা ইবাদাত করে কিন্তু তাদের কলবে থাকে দুনিয়া। আর সাহাবারা ইবাদাত করে তখন তাদের অন্তরে থাকে আখিরাত।

হিসাব দিবস ও প্রতিদান দিবসের ব্যাপারে মুসলমানরা নিঃসন্দেহ। সঠিক বুদ্ধি ও বিবেচনার দাবীও এটাই। আল্লাহ তা'আলা কিতাব নাজিল করেছেন, রাসূল প্রেরণ করেছেন এবং মানুষের জন্য এর উপর বিশ্বাস স্থাপন ও আনুগত্য প্রদর্শনকে ফরয করে দিয়েছেন। আর যারা আল্লাহর আনুগত্য করবে না, ঈমান আনবে না, এবং রাসূলের আনুগত্য করবে না, তাদেরকে কঠিন শাস্তির ওয়াদা করা হয়েছে। সুতরাং যদি কোন হিসাব নিকাশ গ্রহণ ও প্রতিদানের ব্যবস্থা না থাকে, তাহলে আল্লাহর সেসব কথার কোনই অর্থ থাকবে না। অথচ তিনি অনর্থক কাজ থেকে পবিত্র। ইরশাদ হচ্ছে-{অতএব, আমি অবশ্যই তাদেরকে জিজ্ঞেস করব যাদের কাছে রাসুল প্রেরিত হয়েছিল এবং আমি অবশ্যই তাদেরকে জিজ্ঞেস করব রাসুলগণকে। অতঃপর আমি স্বজ্ঞানে তাদের কাছে অবস্থা বর্ণনা করব। বস্তুতঃ আমি অনুপস্থিত তো ছিলাম না।}[সূরা: আ'রাফ, আয়াত-৬- ৭।]

ষষ্ঠত: জান্নাত ও জাহান্নামের উপর ঈমান:

জান্নাত ও জাহান্নাম হচ্ছে সৃষ্টির স্থায়ী ঠিকানা। জান্নাত হচ্ছে সুখের ভূবন। আল্লাহ তা'আলা যা মুমিন ও মুত্তাকীদের জন্য সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহ যেসকল বিষয়ের প্রতি ঈমান আনতে বলেছেন যারা তার উপর বিশ্বাস স্থাপন করেছেন, আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্যে অটল ছিলেন, আল্লাহর প্রতি একনিষ্ঠ এবং রাসূলের অনুসারী ছিলেন, তাদের জন্য এর মধ্যে রয়েছে নানা রকমের নেয়ামত। যা কোন চোখ দেখেনি, কোন কান শুনেনি এবং মানুষের অন্তরে এর কল্পনাও সৃষ্টি হয়নি। আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন-{যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে, তারাই সৃষ্টির সেরা। তাদের পালনকর্তার কাছে রয়েছে তাদের প্রতিদান চিরকাল বসবাসের জান্নাত, যার তলদেশে নির্ঝরিণী প্রবাহিত। তারা সেখানে থাকবে অনন্তকাল। আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট এবং তারা আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট। এটা তার জন্যে, যে তার পালনকর্তাকে ভয় করে।}
[সূরা: আল-বাইয়্যেনাহ, আয়াত:৭- ৮।]

আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন-{কেউ জানে না তার জন্যে কৃতকর্মের কি কি নয়ন-প্রীতিকর প্রতিদান লুক্কায়িত আছে।}[সূরা: আস-সেজদা, আয়াত:১৭]

জান্নাতে সর্বশ্রেষ্ঠ নেয়ামত হলো আল্লাহ তা'আলার চেহারা অবলোকন। আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন-{সেদিন অনেক মুখমন্ডল উজ্জ্বল হবে। তারা তার পালনকর্তার দিকে তাকিয়ে থাকবে।}
[সূরা: আল-কিয়ামাহ, আয়াত:২২- ২৩]

আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন-{যারা সৎকর্ম করেছে তাদের জন্য রয়েছে কল্যাণ এবং তারও চেয়ে বেশী।} [সূরা: ইউনুস, আয়াত:২৬]

এখানে কল্যাণ হচ্ছে জান্নাত, আর অতিরিক্ত হচ্ছে আল্লাহ তা'আলার চেহারা দর্শন। যেমন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-

«যখন জান্নাতবাসী জান্নাতে প্রবেশ করবে, তখন মহাকল্যাণময় আল্লাহ তা'আলা বলবেন, তোমরা অতিরিক্ত কামনা করো কি? তারা বলবে, আপনি কি আমাদের চেহারাকে উজ্জ্বল করেননি? আমাদেরকে জান্নাতে প্রবেশ করাননি? আমাদেরকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেননি? নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তখন আল্লাহ তা'আলা আবরণ উন্মোচন করবেন। তখন জান্নাতবাসীদের কাছে আল্লাহর দর্শন লাভের চেয়ে অধিক প্রিয় কিছু হবে না। এরপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়ালাল্লাম এই আয়াত তেলাওয়াত করেন- {যারা সৎকর্ম করেছে তাদের জন্য রয়েছে কল্যাণ এবং তারও চেয়ে বেশী।}
[সূরা: ইউনুস, আয়াত: ২৬]» (-মুসলিম।)

জাহান্নাম: এটা হচ্ছে আজাবের স্থান। আল্লাহ তা'আলাকে অস্বীকারকারী ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অবাধ্য কাফের ও জালিমদের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন রকমের শাস্তি দেয়ার ব্যবস্থা যা মানুষ কল্পনাও করতে পারে না। আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন-{এবং তোমরা সে আগুন থেকে বেঁচে থাক, যা কাফেরদের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে।}(সূরা: আলে-ইমরান, আয়াত:১৩১ )

তিনি বলেন:{আমি জালেমদের জন্যে অগ্নি প্রস্তুত করে রেখেছি, যার বেষ্টনী তাদের কে পরিবেষ্টন করে থাকবে। যদি তারা পানীয় প্রার্থনা করে, তবে পুঁজের ন্যায় পানীয় দেয়া হবে যা তাদের মুখমন্ডল দগ্ধ করবে। কত নিকৃষ্ট পানীয় এবং খুবই মন্দ আশ্রয়।}[সূরা: আল-কাহাফ, আয়াত: ২৯]

আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন-{নিশ্চয় আল্লাহ কাফেরদেরকে অভিসম্পাত করেছেন এবং তাদের জন্যে জ্বলন্ত অগ্নি প্রস্তুত রেখেছেন। তথায় তারা অনন্তকাল থাকবে এবং কোন অভিভাবক ও সাহায্যকারী পাবে না। যেদিন অগ্নিতে তাদের মুখমন্ডল ওলট পালট করা হবে; সেদিন তারা বলবে, হায়। আমরা যদি আল্লাহর আনুগত্য করতাম ও রাসুলের আনুগত্য করতাম।}[সূরা: আল-আহযাব, আয়াত:৬৪- ৬৬]

জাহান্নামবাসীদের সর্বনিম্ন আজাবের বিষয়ে (আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকে শাস্তি থেকে মুক্তি দিন) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:«কিয়ামতের দিন জাহান্নামবাসীদের সবচেয়ে সহজ শাস্তি হচ্ছে- ব্যক্তির পায়ের নিচে অঙ্গার রেখে দেয়া হবে। যাতে তার মগজ টগবগ করে ফুটতে থাকবে।»
(-বোখারী।)

পরকালের উপর ঈমানের ফলাফল:

১- পরকালের উপর বিশ্বাস ঈমানের একটি স্তম্ভ। পরকালের উপর বিশ্বাস স্থাপন ছাড়া আল্লাহর উপর পরিপূর্ণ ঈমান আনা হয় না। এজন্য যে পরকালের উপর ঈমান আনবে না আল্লাহ তা'আলা তার সাথে জিহাদে অবতীর্ণ হতে বলেছেন। আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন-{তোমরা যুদ্ধ কর আহলে-কিতাবের ঐ লোকদের সাথে, যারা আল্লাহ ও রোজ হাশরে ঈমান রাখে না ।}[সূরা: আত-তাওবাহ, আয়াত:২৯]

২- দুনিয়া ও আখিরাতে নিরাপত্তা ও মহা প্রতিদানের অঙ্গীকার। আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন - {মনে রেখো যারা আল্লাহর বন্ধু, তাদের না কোন ভয় ভীতি আছে, না তারা চিন্তান্বিত হবে।}
[সূরা: ইউনুস, আয়াত: ৬২]

৩- মহা প্রতিদানের অঙ্গীকার। আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন- {নিঃসন্দেহে যারা মুসলমান হয়েছে এবং যারা ইহুদী, নাসারা ও সাবেঈন, (তাদের মধ্য থেকে) যারা ঈমান এনেছে আল্লাহর প্রতি ও কিয়ামত দিবসের প্রতি এবং সৎকাজ করেছে, তাদের জন্য রয়েছে তার সওয়াব তাদের পালনকর্তার কাছে। আর তাদের কোনই ভয়-ভীতি নেই, তারা দুঃখিতও হবে না।}[সূরা: আল-বাক্বারাহ, আয়াত: ৬২]

৪- নেককাজের প্রতি উৎসাহ প্রদান। আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন- {হে ঈমানদারগণ! আল্লাহর নির্দেশ মান্য কর, নির্দেশ মান্য কর রাসূলের এবং তোমাদের মধ্যে যারা বিচারক তাদের। তারপর যদি তোমরা কোন বিষয়ে বিবাদে প্রবৃত্ত হয়ে পড়, তাহলে তা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের প্রতি প্রত্যর্পণ কর-যদি তোমরা আল্লাহ ও কেয়ামত দিবসের উপর বিশ্বাসী হয়ে থাক। আর এটাই কল্যাণকর এবং পরিণতির দিক দিয়ে উত্তম।} [সূরা: আন-নিসা, আয়াত: ৫৯]

আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন-{নিঃসন্দেহে তারাই আল্লাহর মসজিদ আবাদ করবে যারা ঈমান এনেছে আল্লাহর প্রতি ও শেষ দিনের প্রতি।}
[সূরা: আত-তাওবাহ, আয়াত: ১৮]

আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন-{যারা আল্লাহ ও শেষ দিবসের আশা রাখে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে, তাদের জন্যে রাসুলুল্লাহর মধ্যে উত্তম নমুনা রয়েছে।}[সূরা: আল-আহযাব, আয়াত: ২১]

আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন- {তোমরা যারা আল্লাহ ও পরকাল প্রত্যাশা কর, তোমাদের জন্য তাদের মধ্যে উত্তম আদর্শ রয়েছে।}
[সূরা: আল-মুমতাহিনাহ, আয়াত: ৬]

আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন-{তোমরা আল্লাহর উদ্দেশ্যে সাক্ষ্য দিবে, এতদ্দ্বারা যে ব্যক্তি আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস করে, তাকে উপদেশ দেয়া হচ্ছে।}[সূরা: আত-তালাক, আয়াত: ২]

উম্মুল মুমিনীন আয়শা রা. এক মহিলাকে উদ্দেশ্য করে বলেন- মৃত্যুর কথা বেশী বেশী স্মরণ কর। এতে তোমার কলব নরম হবে।

৫- অসৎ কাজ করতে নিষেধ করে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ইরশাদ করেছেন- {আর যদি সে আল্লাহর প্রতি এবং আখেরাত দিবসের উপর ঈমানদার হয়ে থাকে, তাহলে আল্লাহ যা তার জরায়ুতে সৃষ্টি করেছেন তা লুকিয়ে রাখা জায়েজ নয়।}
[সূরা: আল-বাক্বারাহ, আয়াত: ২২৮]

আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন-{আর যখন তোমরা স্ত্রীদেরকে তালাক দিয়ে দাও এবং তারপর তারাও নির্ধারিত ইদ্দত পূর্ন করতে থাকে, তখন তাদেরকে পূর্ব স্বামীদের সাথে পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে নিয়মানুযায়ী বিয়ে করতে বাধাদান করো না। এ উপদেশ তাকেই দেয়া হচ্ছে, যে আল্লাহ ও কেয়ামত দিনের উপর বিশ্বাস স্থাপন করেছে।} [সূরা: আল-বাক্বারাহ, আয়াত: ২৩২]

আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন-{নিঃসন্দেহে তারাই আপনার কাছে অব্যাহতি চায়, যারা আল্লাহ ও রোজ কেয়ামতে ঈমান রাখে না এবং তাদের অন্তর সন্দেহগ্রস্ত হয়ে পড়েছে, সুতরাং সন্দেহের আবর্তে তারা ঘুরপাক খেয়ে চলেছে।}
[সূরা: আত-তাওবাহ, আয়াত: ৪৫]

ফলে যারা পরকালের উপর বিশ্বাস রাখে না তারা অপরাধকর্ম করে বেড়ায়। এ বিষয়ে তারা কোন লজ্জা অনুভব করে না। আল্লাহ তা'আলা বলেন:{আপনি কি দেখেছেন তাকে, যে বিচারদিবসকে মিথ্যা বলে? সে সেই ব্যক্তি, যে এতীমকে গলা ধাক্কা দেয় এবং মিসকীনকে অন্ন দিতে উৎসাহিত করে না।}
[সূরা: মাউন, আয়াত:১- ৩]

হাসান বসরী রহ. বলেন- যে মৃত্যুকে চিনতে পেরেছে সে দুনিয়ার মুছিবত পরোয়া করে না।

৬- পরকালের প্রতি ঈমান আখিরাতে নেয়ামত ও সাওয়াব লাভের আশ্বাস প্রদানের মাধ্যমে মুমিনকে দুনিয়া অপ্রাপ্তির ব্যাপারে সান্ত্বনা দেয়। জান্নাত লাভ একটি মহাসাফল্য। পার্থিব জীবন ধোঁকা ছাড়া অন্য কোন সম্পদ নয়। আল্লাহ তা'আলা বলেন:{প্রত্যেক প্রাণীকে আস্বাদন করতে হবে মৃত্যু। আর তোমরা কিয়ামতের দিন পরিপূর্ণ বদলা প্রাপ্ত হবে। তারপর যাকে দোযখ থেকে দূরে রাখা হবে এবং জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে, তার কার্যসিদ্ধি ঘটবে। আর পার্থিব জীবন ধোঁকা ছাড়া অন্য কোন সম্পদ নয়।}
[সূরা: আলে-ইমরান, আয়াত: ১৮৫]

আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন-{আপনি বলুন, আমি আমার প্রতিপালকের অবাধ্য হতে ভয় পাই কেননা, আমি একটি মহাদিবসের শাস্তিকে ভয় করি। যার কাছ থেকে ঐদিন এ শাস্তি সরিয়ে নেওয়া হবে, তার প্রতি আল্লাহর অনুকম্পা হবে। এটাই বিরাট সাফল্য।}[সূরা: আল-আন’আম, আয়াত: ১৫- ১৬]

আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন-{অথচ পরকালের জীবন উৎকৃষ্ট ও স্থায়ী।}[সূরা: আল-আ’লা, আয়াত-১৭।]

আল্লাহর ইবাদাত, ভালোবাসা ও নৈকট্য ছাড়া অন্তর সংশোধন হয় না, সাফল্য লাভ করে না, প্রফুল্ল হয় না, উপভোগ করতে পারে না, আনন্দ লাভ করে না এবং প্রশান্তি লাভ করে না।

-শাইখুল ইসলাম।



Tags: