লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু এর ফযীলত

লা ইলাহা ইল্লাহ-এর ফযীলত

লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু এর ফযীলত:

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন- «ইসলামের ভিত্তি পাঁচটি: আল্লাহ ব্যতীত আর কোন মাবুদ নেই এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহ তা'আলার রাসূল এ কথার সাক্ষ্য দেয়া, সালাত কায়েম করা, যাকাত আদায় করা, হজ্ব আদায় করা এবং রমযানের রোযা রাখা ।» (-বোখারী।)

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-«আমি এবং আমার পূর্বের নবীরা সর্বোত্তম যে কথাটি বলেছেন তা হচ্ছে- আল্লাহ ছাড়া আর কোন মাবুদ নেই। তাঁর কোন শরীক নেই। রাজত্ব এবং প্রশংসা তাঁর। তিনি সকল বস্তুর উপর ক্ষমতাবান।» (-তিরমিযী।)

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন- «আল্লাহর নবী নূহ আ: মৃত্যুর পূর্বমুহুর্তে তার সন্তানকে বলেছিলেন, আমি তোমাকে 'লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ'এর নির্দেশ করছি। নিশ্চই এক হাতে সাত আসমান ও সাত যমীন যদি রাখা হয়, আর অপর হাতে 'লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ' রাখা হয়, তবে কালিমা বহনকারী হাতটি ভারি হবে। আর সাত আসমান ও যমীনকে যদি একটি রিং এর মতো করে তৈরি করা হতো, তবে 'লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ' কালিমাটির মর্মের ভারত্ব সেটাকে ভেঙ্গে ফেলতে সক্ষম হতো।» (-আদাবুল মুফরাদ।)

'লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ' বা আল্লাহ ব্যতীত কোন মাবুদ নেই- এই বাক্যটিকে কেন্দ্র করেই জান্নাতকে সুশোভিত করা হয়েছে এবং জাহান্নামকে করা হয়েছে উত্তপ্ত এবং পাপ ও পুণ্যের কাজ সম্পাদনের প্রশ্ন এসেছে।

লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু এর শর্তসমূহ:

১- এর মর্ম সম্পর্কে অবগত হওয়া-

আর তা হল এই বাক্যের উক্তিকারী এর মর্ম ও এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিষয়াদীকে রপ্ত করবে। যথা, গাইরুল্লাহর মাবুদ হওয়াকে অস্বীকার করা এবং আল্লাহকেই একমাত্র উপাস্যরূপে গ্রহণ করা ইত্যাদি। আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন-{অত:পর জেনে রাখ যে, আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই।}[সূরা: মুহাম্মাদ, আয়াত: ১৯]

২- দৃঢ় বিশ্বাস স্থাপন করা:

অর্থাৎ লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু এবং এর সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের প্রতি এর সাক্ষ্যদানকারীর অন্তরে কোন সন্দেহ পতিত না হওয়া। আল্লাহ তা'আলা বলেন: {তারাই মুমিন, যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের প্রতি ঈমান আনার পর সন্দেহ পোষণ করে না এবং আল্লাহর পথে প্রাণ ও ধন-সম্পদ দ্বারা জেহাদ করে। তারাই সত্যনিষ্ঠ।}[সূরা: হুজরাত, আয়াত: ১৫]

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন- «যখন কোন বান্দা কোন ধরনের সন্দেহ ও সংশয় ব্যতিরেকে 'আল্লাহ ব্যতীত কোন মাবুদ নেই এবং মুহাম্মাদ সা. আল্লাহর রাসূল' এই মর্মে সাক্ষ্য দিবে এবং এই বিশ্বাস নিয়েই আল্লাহর দরবারে উপস্থিত হবে, সে অবশ্যই জান্নাতে প্রবেশ করবে।» (-মুসলিম।)

৩- এই বাক্যের দাবীকে অন্তরিক এবং মৌখিকভাবে স্বীকার ও গ্রহণ করা:

এখানে অন্তর থেকে এবং মৌখিকভাবে গ্রহণ করা বলতে উদ্দেশ্য হলো এই বিশ্বাসকে প্রত্যাখ্যান না করা। আল্লাহ তা'আলা বলেন:{অপরাধীদের সাথে আমি এমনি ব্যবহার করে থাকি। তাদের যখন বলা হত, আল্লাহ ব্যতীত কোন উপাস্য নেই, তখন তারা ঔদ্ধত্য প্রদর্শন করত।}
[সূরা: আস-সাফ্‌ফাত, আয়াত: ৩৪- ৩৫]

৪- কালিমাতুত তাউহীদের আলোকে প্রমাণিত বিষয়াদীর সম্মুখে নিজেকে সমর্পন করা।

অর্থাৎ বান্দা আল্লাহর নির্দেশিত বিষয়ের উপর আমল করবে এবং তাঁর নিষিদ্ধ বিষয়কে বর্জন করবে। আল্লাহ তা'আলা বলেন:

{যে ব্যক্তি সৎকর্মপরায়ণ হয়ে স্বীয় মুখমন্ডলকে আল্লাহ অভিমূখী করে, সে এক মজবুত হাতল ধারণ করে, সকল কর্মের পরিণাম আল্লাহর দিকে।}
[সূরা: লুকমান, আয়াত: ২২]

প্রকৃত গোলামী হচ্ছে অন্তরের গোলামী ও দাসত্ব। সুতরাং যে তাঁর দাসত্ব গ্রহণ করবে সে তাঁর বান্দা হিসেবে বিবেচিত হবে।

৫- সত্যায়ন করা:

অর্থ হলো বান্দা “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু” অন্তর থেকে বলা এবং তার কথা ও কাজের মাধ্যমে ইহাকে সত্যায়ন করা। আল্লাহ তা'আলা বলেন:

{আর মানুষের মধ্যে কিছু লোক এমন রয়েছে যারা বলে, আমরা আল্লাহ ও পরকালের প্রতি ঈমান এনেছি অথচ আদৌ তারা ঈমানদার নয়। তারা আল্লাহ এবং ঈমানদারগণকে ধোঁকা দেয়। অথচ এতে তারা নিজেদেরকে ছাড়া অন্য কাউকে ধোঁকা দেয় না অথচ তারা তা অনুভব করতে পারে না।} [সূরা: আল-বাক্বারাহ, আয়াত: ৮- ৯।]

(৬) ইখলাস

ইখলাস হলো এই কালিমার মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের ইচ্ছা করা। আল্লাহ তা'আলা বলেন:{তাদেরকে এছাড়া কোন নির্দেশ করা হয়নি যে, তারা খাঁটি মনে একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর এবাদত করবে, নামায কায়েম করবে এবং যাকাত দেবে। এটাই সঠিক ধর্ম।}[সূরা: আল-বায়্যিনাহ, আয়াত: ৫]

৭- এই কালিমা ও কালিমা ধারণকারীদের মুহাব্বত করা যারা এর উপর আমল করে এবং তার শর্তসমূহের সাথে অঙ্গিকারাবদ্ধ। আল্লাহ তা'আলা বলেন:{আর কোন লোক এমনও রয়েছে যারা অন্যান্যকে আল্লাহর সমকক্ষ সাব্যস্ত করে এবং তাদের প্রতি তেমনি ভালবাসা পোষণ করে, যেমন আল্লাহর প্রতি ভালবাসা হয়ে থাকে। কিন্তু যারা আল্লাহর প্রতি ঈমানদার তাদের ভালবাসা ওদের তুলনায় বহুগুণ বেশী।}
[সূরা: আল-বাক্বারাহ, আয়াত: ১৬৫]

যখনই অন্তরে আল্লাহর ভালোবাসা বৃদ্ধি পায়, তখন তাঁর বন্দেগীর চাহিদা বৃদ্ধি পায়, এবং তিনি ছাড়া অন্য বিষয় থেকে নিজেকে মুক্ত মনে করার অভ্যাস গড়ে ওঠে।

এগুলো লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু এর তাৎপর্য। আর বর্ণিত শর্তাবলী আল্লাহর নিকট নাজাতের কারণ হিসাবে বিবেচিত হবে। একদা হযরত হাসান বসরী রা.-কে বলা হলো কিছু মানুষ বলে, যে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু বলবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। তখন তিনি ব্যাখ্যা করে বললেন, যে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু বলবে তারপর তার দাবী ও বিধানাবলী আদায় করবে সে জান্নাতে যাবে।

“লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু” পাঠকারী যতক্ষণ না কালিমার দাবি পূর্ণ সম্পাদন না করবে এবং তার শর্তসমূহ পূরণ না করবে ততক্ষণ সেই কালিমা তার কোন উপকারে আসবে না। কালিমা উচ্চারণের সাথে সাথে আমলও যুক্ত হতে হবে, তবেই কেবল সে উপকৃত হতে পারবে কালিমা দ্বারায়।

লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু এর বিশ্বাস ভঙ্গকারী কাজ সমূহ:

১- শিরক, এখানে শিরক বলতে উদ্দেশ্য হলো-

বড় শিরক। যা মানুষকে ইসলাম থেকে বহিষ্কার করে দেয়। যে শিরক নিয়ে মৃত্যু বরণ করলে আল্লাহ তা'আলা উক্ত ব্যক্তিকে ক্ষমা করেন না। আর বড় শিরক হলো আল্লাহ তা'আলার হকের বিষয়ে অর্থাৎ তাঁর ইবাদাত ও উপাসনা এবং পালনকতৃত্বের বিষয়ে অন্য কাউকে তাঁর সঙ্গে শরীক সাব্যস্ত করা, কিংবা তাঁর নাম ও গুনাবলীর ক্ষেত্রে অন্য কাউকে অংশীদার সাব্যস্ত করা। আল্লাহ তা'আলা বলেন:{নিশ্চয় আল্লাহ তাকে ক্ষমা করেন না, যে তাঁর সাথে কাউকে শরীক করে। এছাড়া যাকে ইচ্ছা, ক্ষমা করেন। যে আল্লাহর সাথে শরীক করে সে সুদূর ভ্রান্তিতে পতিত হয়।}
[সূরা: আন-নিসা, আয়াত: ১১৬]

কারো জন্যই আল্লাহ ছাড়া অন্যকে ডাকা সমীচীন নয়, আর যেভাবে ডাকতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে শুধু সেভাবেই ডাকার অনুমতি রয়েছে। আর এ বিষয়টি স্পষ্ট হয় আল্লাহর নিম্নোক্ত বানী থেকে - {আর আল্লাহর জন্য রয়েছে সব উত্তম নাম। কাজেই সে নাম ধরেই তাঁকে ডাক। আর তাদেরকে বর্জন কর, যারা তাঁর নামের ব্যাপারে বাঁকা পথে চলে। তারা নিজেদের কৃতকর্মের ফল শীঘ্রই পাবে।} [সূরা: আ'রাফ, আয়াত: ১৮০।]

-ইমাম আবু হানীফা।

আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন:{আপনার প্রতি এবং আপনার পূর্ববর্তীদের প্রতি প্রত্যাদেশ হয়েছে, যদি আল্লাহর শরীক স্থির করেন, তবে আপনার কর্ম নিষ্ফল হবে এবং আপনি ক্ষতিগ্রস্তদের একজন হবেন। বরং আল্লাহরই এবাদত করুন এবং কৃতজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত থাকুন।}
[সূরা: জুমার, আয়াত: ৬৫- ৬৬]

২- যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর মাঝে বিভিন্ন মধ্যস্থতাকারী সাব্যস্ত করবে এ উদ্দেশ্যে যে, উক্ত মধ্যস্থতাকারীর নিকট দুআ করবে এবং তার কাছে সুপারিশ প্রার্থনা করবে, তার উপর ভরসা করবে এবং ইবাদাতের ক্ষেত্রে তার আনুগত্য করবে, এর মাধ্যমে সে “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু” এর বিশ্বাস ভঙ্গকারী হিসেবে বিবেচিত হবে।

৩- যে মুশরিকদেরকে কাফের বলবে না, বা তাদের কুফরীতে সন্দেহ করবে কিংবা তাদের মতাদর্শকে বিশুদ্ধ সাব্যস্ত করবে সে কুফরী করেছে বলে গণ্য হবে। কেননা সে আল্লাহর একমাত্র মনোনিত, নির্বাচিত ধর্ম ইসলামের বিধানবলীর অন্তর্ভূক্ত বিষয়ে সন্দেহপোষণকারী। সুতরাং যে বান্দা আল্লাহ ছাড়া অন্যকে অস্বীকার করার ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করবে, বা তাঁর ইবাদাতে কোন পরিবর্তন করবে, কিংবা ইহুদি, নাসারা, অগ্নি উপাসকদের কুফরীর ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করবে, অথবা তাদের জাহান্নামে যাওয়ার ব্যাপারে সন্দেহ করবে অথবা মুশরিকদের এমন কোন কর্ম বা মতাদর্শের বিষয়কে বিশুদ্ধ মনে করবে যার বিরুদ্ধে কোরআন হাদীসে বক্তব্য এসেছে তবে সে কুফরি করেছে বলে গণ্য হবে।

৪- যে ব্যক্তি রাসূলের হেদায়াতবাণীর চেয়ে অন্য কোন হেদায়াতবাণীকে অধিক পরিপূর্ণ মনে করবে, অন্য কারো প্রজ্ঞাকে তাঁর প্রজ্ঞার চেয়ে অধিক উত্তম মনে করবে, সে কুফরী করেছে বলে গণ্য হবে। তেমনি যে কোন সামাজিক বিধান বা কোন আদর্শিক নীতিকে শরীয়তের বিধানের উপরে প্রাধান্য দেবে অথবা তার হুকুমকে জায়েজ বলে বিশ্বাস করবে অথবা সেগুলোকে শরীয়তের অনুরূপ মনে করবে- তবে এসবও মহান আল্লাহর বিরুদ্ধে কুফরী হিসেবে বিবেচিত হবে। আল্লাহ তা'আলা বলেন: {যেসব লোক আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন, তদনুযায়ী ফায়সালা করে না, তারাই কাফের।}[সূরা: মায়িদাহ, আয়াত: ৪৪]

আল্লাহ তা'আলা বলেন:{অতএব, তোমার পালনকর্তার কসম, সে লোক ঈমানদার হবে না, যতক্ষণ না তাদের মধ্যে সৃষ্ট বিবাদের ব্যাপারে তোমাকে ন্যায়বিচারক বলে মনে না করে। অতঃপর তোমার মীমাংসার ব্যাপারে নিজের মনে কোন রকম সংকীর্ণতা পাবে না এবং তা হূষ্টচিত্তে কবুল করে নেবে।}[সূরা: আন-নিসা, আয়াত: ৬৫]

৫- রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে বিধান এনেছেন সেগুলোর কোন একটি যদি কেউ অপছন্দ করে, (সে উক্ত বিধান পালন করলেও তার কাছে অপ্রিয় হওয়ার কারণে) সে কাফের হয়ে যাবে। সুতরাং যে সালাত অপছন্দ করবে সে সালাত আদায় করলেও কাফের বলে বিবেচিত হবে। কেননা সে আল্লাহর নির্দেশ অপছন্দ করেছে। আর লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু এর একটি শর্ত হচ্ছে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক আল্লাহর পক্ষ থেকে আনীত বিষয়াবলীর প্রত্যেকটিকে মনেপ্রাণে মুহাব্বত করা। আর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে বিধান নিয়ে এসেছেন তা যে ব্যক্তি অপছন্দ করবে সে যেন শাহাদাত (মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রাসূল) হওয়াকেই প্রকৃত অর্থে অপছন্দ করলো। কারণ কালিমায়ে শাহাদাতের দাবি হলো রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে বিধান আনয়ন করেছেন তার প্রতি নিজেকে সমর্পন করা এবং আনন্দচিত্তে তা মেনে নেওয়া।

৬- যে আল্লাহর দ্বীনের কোন বিষয়, ছাওয়াব বা শাস্তি সম্পর্কে ঠাট্টা করবে সে কুফরী করেছে বলে বিবেচিত হবে। কেননা সে এই দ্বীনের প্রতি অসম্মান প্রদর্শন করেছে যে দ্বীনের প্রতি এবং যে দ্বীনের আনয়নকারীর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা তার উপর আবশ্যক। আর এ কারণেই আল্লাহ সে সকল ব্যক্তির ব্যাপারে কুফরীর ফয়সালা দিয়েছেন, যারা আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সাহাবীদের ব্যাপারে ঠাট্টা বিদ্রূপ করেছে। তারা বলতো-''আমাদের এসব কারী সাহেবদের (সাহাবায়ে কেরামের) মতো অধিক লোভী ও মিথ্যুক এবং ভীরু কাউকে দেখিনি।'' তখন আল্লাহ তা'আলা নাযিল করেছেন-

{আর যদি তুমি তাদের কাছে জিজ্ঞেস কর, তবে তারা বলবে, আমরা তো কথার কথা বলছিলাম এবং কেতুক করছিলাম। আপনি বলুন, তোমরা কি আল্লাহর সাথে, তাঁর হুকুম আহকামের সাথে এবং তাঁর রাসুলের সাথে ঠাট্টা করছিলে? ছলনা কর না, তোমরা যে কাফের হয়ে গেছ ঈমান প্রকাশ করার পর।} [সূরা: আত-তাওবাহ, আয়াত: ৬৫- ৬৬]

আল্লাহ তা'আলা তাদের কুফরীর রায় ঘোষণা দিয়েছেন যদিও তারা পূর্বে মুমিন ছিলো। নিম্মোক্ত বাক্যটি এবিষয়কে প্রমাণিত করে:{তোমরা যে কাফের হয়ে গেছ ঈমান প্রকাশ করার পর।}
[সূরা: আত-তাওবাহ, আয়াত: ৬৬]

সুতরাং তারা যে জঘন্য কথা বলেছিল, তার বিবরণ দেওয়ার পূর্বেই আল্লাহ তা'আলা তাদেরকে 'ঈমানদার' সাব্যস্ত করেছেন, তারপর তাদের কৃতকর্মের কারণে তাদেরকে কাফের ঘোষণা করেছেন। অথচ তারা সে কথাগুলো বলেছিলো ঠাট্টাচ্ছলে এবং তারা চেয়েছিলো এর দ্বারা পথের কাঁটা দূর করতে।

৭। যাদু :

যাদু হলো এমন সব মন্ত্রপাঠ, ঝাড়-ফুঁক ও গিরাকষা, যার মাধ্যমে মানুষের অন্তর ও শরীরে প্রভাব বিস্তার করে, হত্যাকাণ্ড ও এধরনের কাজে উৎসাহিত করে, স্বামী-স্ত্রীর মাঝে বিভেদ সৃষ্টি করে,আর এটা কুফর। আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন-{তারা ভালরূপে জানে যে, যে কেউ যাদু অবলম্বন করে, তার জন্য পরকালে কোন অংশ নেই।}
[সূরা: আল-বাক্বারাহ, আয়াত: ১০২]

অর্থাৎ পরকালে তারা কিছুই পাবে না, এর আগে আল্লাহ তা'আলা বলেন:{তারা উভয়ই একথা না বলে কাউকে শিক্ষা দিত না যে, আমরা পরীক্ষার জন্য; কাজেই তুমি কাফের হয়ো না।}
[সূরা: আল-বাক্বারাহ, আয়াত: ১০২]

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন- «তোমরা সাতটি ধ্বংসকারী বস্তু হতে দূরে থাকবে। তখন সাহাবাগণ জিজ্ঞাসা করলেন, ধ্বংসকারী সাতটি বস্তু কি? উত্তরে তিনি বললেন, (১) আল্লাহর সাথে শরীক করা (২) যাদু টোনা করা (৩) আইনের বিধান ব্যতিরেকে কাউকে হত্যা করা (৪) সুদ খাওয়া (৫) অন্যায়ভাবে ইয়াতিমের মাল সম্পদ ভোগ করা (৬) যুদ্ধ জেহাদের ময়দান হতে পলায়ন করা (৭) ঈমানদার নির্দোষ সতীসাধ্বী নারীর প্রতি মিথ্যা অপবাদ দেওয়া।»
(-বোখারী।)

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন- «যে ব্যক্তি সুতায় গ্রন্থি দিল, অতঃপর তাতে ফুঁক দিল, সে যাদু করল। আর যে ব্যক্তি যাদু করল সে শিরক করল। যে নিজের কল্যাণ ও অকল্যাণকে কোন বস্তুর সাথে সম্পৃক্ত করবে তাকে ঐ বস্তুর কাছেই সোপর্দ করা হবে।»
(-নাসায়ী।)

আর জ্যোতিষশাস্ত্র এবং নক্ষত্ররাজির দ্বারা পৃথিবীর ঘটমান বিষয়ের দলীল হিসাবে পেশ করাও যাদুটোনার অন্তর্ভুক্ত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন- «যে ব্যক্তি তারকা থেকে তথ্য আহরণ করতে চেষ্টা করবে সে যাদুর একটি অংশ আহরণ করল। যে ব্যক্তি এ প্রক্রিয়া অধিক হারে প্রয়োগ করবে সে যেন যাদুকর্ম অধিক হারে প্রয়োগ করল।» (-বায়হাকী।)

আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন: {যাদুকর যেখানেই থাকুক, সফল হবে না।}[সূরা: ত্বহা, আয়াত: ৬৯।]

প্রণয় ও বিচ্ছেদ সৃষ্টিও যাদুর অন্তর্ভুক্ত। অর্থাৎ দুজন প্রিয় মানুষের মাঝে বিচ্ছেদ কিংবা অন্য দুজনের মাঝে প্রণয়ের সৃষ্টি করা।

উপকারী জ্ঞান বান্দাকে আল্লাহর একত্ববাদের প্রতি বিশ্বাসী করে তোলে আর মানুষকে খেদমত ও অনুগ্রহ করার প্রতি আগ্রহী করে তোলে। আর অপকারী জ্ঞান বান্দাকে শিরকের দিকে অগ্রসর করে, সাথে সাথে মানুষের ক্ষতি ও অবজ্ঞা করার প্রতি উদ্বুদ্ধ করে তোলে।

৮। মুসলিম বিরোধীদের প্রতি সহায়তা ও সহযোগিতা প্রদর্শন করা যাকে কোরআনে 'বন্ধুরূপে গ্রহণ' বলে আখ্যা দেয়া হয়েছে। যেমন আল্লাহর বাণী-{তোমাদের মধ্যে যে তাদের সাথে বন্ধুত্ব করবে, সে তাদেরই অন্তর্ভুক্ত।}
[সূরা: আল-মায়িদাহ, আয়াত: ৫১]

(তাওয়াল্লী) التولي আর (মুয়ালাহ) الموالاة এক নয়। এখানে (মুয়ালাহ) الموالاة বলতে বুঝানো হয়েছে (মুশরিকদের প্রতি) আকর্ষণ, সাহচার্য। আর (তাওয়াল্লী) التولي হচ্ছে মুসলিম বিরোধীদেরকে সহযোগিতা করা এবং তাদের সাথে যুক্ত হয়ে মুসলমানদের বিরুদ্ধে চক্রান্তে লিপ্ত হওয়া। যেমনটি মুনাফিকদের অবস্থা ছিল। যদি দুনিয়াবী বিষয়ে কেউ মুশরিকদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করে তাহলে সেও মহা ক্ষতির দারপ্রান্তে বলে বিবেচিত হবে।

যে মনে করবে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শরীয়ত ত্যাগ করলে তার স্বচ্ছলতা আসবে, সে কাফের। কেননা আল্লাহ তা'আলা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাধ্যমে যে ইসলামী শরীয়ত প্রেরণ করেছেন তা সকল শরীয়তের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। আর ইসলাম ব্যতীত কোন ধর্মই আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য নয়। আল্লাহ বলেছেন:{নিঃসন্দেহে আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য দ্বীন একমাত্র ইসলাম।}
[সূরা: আলে-ইমরান, আয়াত: ১৯।]

আল্লাহ তা'আলা বলেছেন:{যে লোক ইসলাম ছাড়া অন্য কোন ধর্ম তালাশ করে, কস্মিণকালেও তা গ্রহণ করা হবে না এবং আখেরাতে সে ক্ষতিগ্রস্ত।}
[সূরা: আলে-ইমরান, আয়াত: ৮৫]

আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন- {বলুন, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালবাস, তাহলে আমাকে অনুসরণ কর, যাতে আল্লাহ ও তোমাদিগকে ভালবাসেন, এবং তোমাদিগকে তোমাদের পাপ মার্জনা করে দেন। আর আল্লাহ হলেন ক্ষমাকারী দয়ালু। বলুন, আল্লাহ ও রাসুলের আনুগত্য প্রকাশ কর। বস্তুত: যদি তারা বিমুখতা অবলম্বন করে, তাহলে আল্লাহ কাফেরদিগকে ভালবাসেন না।}[সূরা: আলে-ইমরান, আয়াত: ৩১- ৩২]

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- «শপথ ঐ সত্তার যার হাতে মুহাম্মদের প্রাণ, এই উম্মতের যেকেউ ইহুদী বা খ্রিস্টান আমার নবুওয়াতের কথা শুনবে, অথচ যা সহকারে আমি প্রেরিত হয়েছি তার প্রতি ঈমান না এনে মৃত্যু বরণ করবে, সে নিশ্চয় জাহান্নামী হবে।» (-মুসলিম।)

তার একটি দৃষ্টান্ত হলো, কিছু মূর্খ মনে করে যে, তাদের বুযুর্গ ও ওলীগণ মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আনুগত্যের উর্ধে উঠে গেছে। এটা সরাসরি কুফুরী ও ইসলাম ত্যাগ।

অন্তর যদি একনিষ্টভাবে আল্লাহ অভিমুখী না হয়, তিনি ব্যতীত অন্য সকল বিষয় থেকে বিমুখ না হয়, তবে সে মুশরিক ।

যে ব্যক্তি সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর দ্বীন থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং তা চর্চা না করে সে কাফের। আর যে ব্যক্তি দ্বীনের আমল থেকে বিলকুল মুখ ফিরেয়ে নিয়েছে, আর সে যে কুফুরীতে লিপ্ত তাতেই তুষ্টি ও স্বনির্ভরতা জাহির করে, যখন তাকে ইসলাম সংক্রান্ত কোন কাজ বা তা'লীমের দিকে আহবান করা হয়, তখন সে সেটাকে প্রত্যাখ্যান করে কিংবা দ্বীনের ইলম হাসিলের পর সেটাকে গ্রহণ ও তার অনুপাতে আমল করার বিষয়কে প্রত্যাখ্যান করে তবে সেও কাফের।

ইসলাম ভঙ্গকারী এসব বিষয় ইচ্চা করে কিংবা মিছামিছি কিংবা কারো ভয়ে করার মাঝে কোন পার্থক্য নেই। জেনেশুনে এর কোন একটিতে লিপ্ত হলেই সে কাফের। তবে কাউকে বাধ্য করার ফলে সে কেবল মুখে এর কোনটি স্বীকার করলে তার বিষয়টি ব্যতিক্রম। আল্লাহ তা'আলা বলেছেন:

{যার উপর জবরদস্তি করা হয় এবং তার অন্তর বিশ্বাসে অটল থাকে সে ব্যতীত যে কেউ বিশ্বাসী হওয়ার পর আল্লাহতে অবিশ্বাসী হয় এবং কুফরীর জন্য মন উম্মুক্ত করে দেয় (তাদের উপর আপতিত হবে আল্লাহর গযব এবং তাদের জন্যে রয়েছে শাস্তি)।}[সূরা: নাহল, আয়াত: ১০৬]

যাকে কুফরী করতে বাধ্য করা হয়েছে তারপর সে খুশীমনে কুফুরীকে মেনে নিয়েছে, সে কাফের। কেননা সে কুফরীর জন্য বক্ষ উন্মেচিত করেছে তথা মানসিকভাবে প্রস্তুত ও সন্তষ্ট ছিল। আর যে মৃত্যুর আশঙ্কা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য এমনটি করবে, অথচ তার অন্তর ঈমানে পরিপূর্ণ এবং পরিতৃপ্ত, তার ঈমান নিরাপদ। তার উপর কোন কিছু বর্তাবে না। আল্লাহ তা'আলা বলেন- {তবে যদি তোমরা তাদের পক্ষ থেকে কোন অনিষ্টের আশঙ্কা কর}[সূরা: আলে-ইমরান, আয়াত: ২৮]

ইলম এমন একটি গাছতুল্য যা সুন্দর চরিত্র, সৎকর্ম এবং প্রশংসিত গুণ উৎপাদন করে। আর মূর্খতা এমন গাছতুল্য যা নিকৃষ্ট চরিত্র ও তিরস্কারযোগ্যগুণ উৎপন্ন করে।

Tags: