ঈমানের প্রভাব ও নিদর্শন

ঈমানের নিদর্শন

ঈমানের প্রভাবসমূহ

ঈমানের ফলশ্রুতিতে ঈমানদারের জীবনে যেসব প্রভাব পরিলক্ষিত হয়:

১- ঈমানদারের মাঝে পবিত্রতম ইসলামী শরিয়তের আনুগত্যের স্পৃহা বেড়ে যায়। আল্লাহ তা'আলা বলেন: {মুমিনদের বক্তব্য কেবল এ কথাই যখন তাদের মধ্যে ফয়সালা করার জন্যে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের দিকে তাদেরকে আহবান করা হয়, তখন তারা বলে: আমরা শুনলাম ও আদেশ মান্য করলাম। তারাই সফলকাম।}
[সূরা: নূর, আয়াত: ৫১]

সুতরাং ঈমানদারকে তার ঈমান আল্লাহর আনুগত্য ও তাঁর নির্দেশের প্রতি বশ্যতা অবলম্বনে উদ্বুদ্ধ করে।

আল্লাহর প্রতি ঈমান হলো জীবন…আর জীবনে আল্লাহর সঙ্গ থাকাই হলো ঈমান..

আল্লাহ তা'আলা বলেন:{অতএব, তোমার পালনকর্তার কসম, সে লোক ঈমানদার হবে না, যতক্ষণ না তাদের মধ্যে সৃষ্ট বিবাদের ব্যাপারে তোমাকে ন্যায় বিচারক বলে মনে না করে। অতঃপর তোমার মীমাংসার ব্যাপারে নিজের মনে কোন রকম সংকীর্ণতা পাবে না এবং তা হূষ্টচিত্তে কবুল করে নেবে।}[সূরা: নিসা, আয়াত: ৬৫]

বরং ঈমান একজন ঈমানদারকে আল্লাহর নির্দেশের প্রতি আত্মসমর্পন ও সন্তষ্ট থাকতে উৎসাহ যোগায়।

২- আরেকটি আলামত হলো আল্লাহ তা'আলা ঈমানদারকে প্রকাশ্য ও প্রচ্ছন্ন শিরক থেকে রক্ষা করেন। আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো কাছে দু'আ বা প্রার্থনা করা কিংবা মদদ ও সাহায্য চাওয়া থেকে বিরত থাকাও এর অন্তর্ভুক্ত। কারণ, উপকার ও অপকার দানের মালিক একমাত্র আল্লাহ তা'আলা। আল্লাহ তা'আলা বলেন:{আর যদি আল্লাহ তোমাকে কোন কষ্ট দেন, তবে তিনি ব্যতীত তা অপসারণকারী কেউ নেই।}[সূরা: আন'আম, আয়াত: ১৭]

৩- আল্লাহর জন্য ভালবাসা ও আল্লাহর জন্য অপছন্দ করা, এটা হলো ঈমানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও মজবুত আলামত। আল্লাহ তা'আলা বলেন:{নিঃসন্দেহে ঈমানদারগণ পরস্পর পরস্পরের ভাই।}[সূরা: হুজুরাত, আয়াত: ১০]

ইসলামের প্রথম যুগের মুহাজির সাহাবীদের জন্য মদীনার আনসারীগণের জান ও মাল ব্যয়ের নজিরবিহীন আত্মত্যাগের ইতিহাস সবচেয়ে বড় দলিল বহন করে যে, ঈমানদাররা আল্লাহর জন্য ভালবাসে ও তাঁর জন্য ঘৃণা করে, এবং ঈমানদারগণ পরস্পর পরস্পরের ভাই। এ প্রসঙ্গে আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: «তোমাদের কেউ ততক্ষণ পর্যন্ত ঈমানদার হতে পারবে না, যতক্ষণ না সে তার মুসলিম ভাইয়ের জন্য তা পছন্দ করবে যা সে নিজের জন্য পছন্দ করে।»
(হাদীসটি ইমাম বুখারী বর্ণনা করেছেন।)

{হে ঈমানদারগণ তোমরা ঈমান আন..} এই আয়াতে আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকে 'ঈমান' এর সাথে সম্বন্ধ করে ডেকেছেন এবং ঈমান আনতে উদ্বুদ্ধ করেছেন।এটা কেবল ঈমানের গুরুত্ব বুঝানোর জন্য।

৪- আল্লাহর রাহে জিহাদে আত্মনিয়োগ করা এবং নিজের প্রিয় ও উৎকৃষ্ট বস্তুটি আল্লাহর সন্তষ্টি লাভের আশায় ব্যয় করা। আল্লাহ তা'আলা বলেন: {তারাই মুমিন, যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের প্রতি ঈমান আনার পর সন্দেহ পোষণ করে না এবং আল্লাহর পথে প্রাণ ও ধন-সম্পদ দ্বারা জেহাদ করে। তারাই সত্যনিষ্ঠ।}
[সূরা: হুজুরাত, আয়াত: ১৫]

৫- অন্তরে মহান আল্লাহ ও তাঁর অঙ্গিকার সমূহ গেঁথে যাওয়া। একজন মু'মিনের জন্য ঈমান ও রাহমানুর রাহীমের অনুসরণ দুনিয়ার জান্নাততূল্য। একই সঙ্গে সে আল্লাহর নিকট আখেরাতের জান্নাতের কামনা পোষণ করে এমনকি দৈনন্দিন জীবনের যেকোনো দুখে ও কষ্টে সে আল্লাহর নিকট উত্তম বিনিময় এবং সেগুলো তার নেক আমলের খাতায় লিপিবদ্ধ হওয়ার আশা পোষণ করে। আল্লাহ তা'আলা বলেন:

{মদীনাবাসী ও পাশ্ববর্তী পল্লীবাসীদের উচিত নয় রাসুলুল্লাহর সঙ্গ ত্যাগ করে পেছনে থেকে যাওয়া এবং রাসুলের প্রাণ থেকে নিজেদের প্রাণকে অধিক প্রিয় মনে করা। এটি এজন্য যে, আল্লাহর পথে যে তৃষ্ণা, ক্লান্তি ও ক্ষুধা তাদের স্পর্শ করে এবং তাদের এমন পদক্ষেপ যা কাফেরদের মনে ক্রোধের কারণ হয় আর শত্রুদের পক্ষ থেকে তারা যা কিছু প্রাপ্ত হয়-তার প্রত্যেকটির পরিবর্তে তাদের জন্য লিখিত হয় নেক আমল। নিঃসন্দেহে আল্লাহ সৎকর্মশীল লোকদের হক নষ্ট করেন না। আর তারা অল্প-বিস্তর যা কিছু ব্যয় করে, যত প্রান্তর তারা অতিক্রম করে, তা সবই তাদের নামে লেখা হয়, যেন আল্লাহ তাদের কৃতকর্মসমূহের উত্তম বিনিময় প্রদান করেন।} [সূরা: তাওবা, আয়াত: ১২০-১২১]

আল্লাহর প্রতি যারা ঈমান আনে এবং নিজ ক্রিয়া-কর্মে ঈমানদারিত্বের পরিচয় দেয়, তাদের মাঝে এসব নিদর্শন বিদ্যমান থাকে।

৬- আল্লাহ ও রাসুলের বন্ধুতা লাভ। ইরশাদ হচ্ছে:{তোমাদের বন্ধু তো আল্লাহ তাঁর রাসুল এবং মুমিনবৃন্দ}[সূরা: মায়েদা, আয়াত: ৫৫]

আল্লাহর সঙ্গে বন্ধুতার অর্থ হলো তাঁকে ভালবাসা, তাঁর দ্বীনকে সাহায্য করা ও তাঁর প্রিয় বান্দাদেরকে ভালবাসা এবং যারা এর বিপরীত তাদের প্রতি বৈরি থাকা। আল্লাহ তা'আলা বলেন:

{যারা আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস করে, তাদেরকে আপনি আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের বিরুদ্ধাচরণকারীদের সাথে বন্ধুত্ব করতে দেখবেন না, যদিও তারা তাদের পিতা, পুত্র, ভ্রাতা অথবা জ্ঞাতি-গোষ্ঠী হয়। তাদের অন্তরে আল্লাহ ঈমান লিখে দিয়েছেন এবং তাদেরকে শক্তিশালী করেছেন তাঁর অদৃশ্য শক্তি দ্বারা। তিনি তাদেরকে জান্নাতে দাখিল করবেন, যার তলদেশে নদী প্রবাহিত। তারা তথায় চিরকাল থাকবে। আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট এবং তারা আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট। তারাই আল্লাহর দল। জেনে রাখ, আল্লাহর দলই সফলকাম হবে।}[সূরা: মুজাদালাহ, আয়াত: ২২]

মু'মিন কেবল আল্লাহ এবং তাঁর রাসুল ও মুমিনদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করে, এবং কোন অবস্থাতেই কাফেরদেরকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করে না। আল্লাহ তা'আলা বলেন:{মুমিনরা কখনো মুমিনদের ছাড়া কাফেরদেরকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করে না।}[সূরা: আলে ইমরান, আয়াত: ২৮]

৭- ঈমানদার উত্তম চরিত্রের অধিকারী হয়। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন:

«লজ্জা ও ঈমান একটি অপরটির অবিচ্ছেদ্য সঙ্গি। একটি না থাকলে অপরটিও থাকবে না।»
(হাদীসটি ইমাম বাইহাকী বর্ণনা করেছেন।)

লজ্জা হলো সচ্চরিত্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক। সুতরাং একজন ঈমানদার তার মুমিন ভাইদের সঙ্গে উত্তম ব্যবহার করবে, যাতে কোন ঝগড়া ফাসাদ ও বিপত্তিহীনভাবে দুনিয়াবী জীবন উপভোগ করতে পারে..এসব গুন-বৈশিষ্ট্য লাভের একমাত্র কারণ হলো সে মুমিন। এগুলো কেবল মুমিনেরই বৈশিষ্ট্য।

৮- প্রকৃত সুখ-সৌভাগ্য ও আত্মার প্রশান্তি লাভ। যার ফলে ঈমানদার অনুভব করবে যে, সুখ ও মানসিক প্রশান্তির কারণে সে যেন দুনিয়ার জান্নাতে অবস্থান করছে। কেননা তার একজন রব আছেন, তিনি হলেন মহীমাময় আল্লাহ। তার একজন নবী আছেন, তিনি হলেন মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তার একটি জীবনাদর্শ আছে, সেটা হলো আল্লাহর সন্তষ্টি অর্জন করা এবং তার একটি লক্ষ আছে, সেটা হলো নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলের মতো প্রস্থ জান্নাতের অধিকারী হওয়া।

আপনি যদি ডানে বামে নজর দেন, দেখতে পাবেন মানসিক চিকিৎসাকেন্দ্র সমূহ রুগী দ্বারা পরিপূর্ণ। চতুর্দিক থেকে আপনি শুনতে পাবেন গ্লানি, অশান্তি অভিযোগ, অনিদ্রা, দুঃসপ্ন ও দুঃসহ জীবনের হাহাকার। নিশ্চিতভাবে জেনে রাখুন, এসব অশান্তির আসল কারণ হলো আল্লাহর প্রতি ঈমান থেকে দুরে থাকা এবং সীমাহীন দুনিয়ামুখিতা ও দুনিয়ার সাথে গভীর সম্পর্ক স্থাপন। সুতরাং বস্তুবাদ ও পার্থিব উপকরণ মানুষের আত্মার উপর প্রভাব বিস্তার করে এবং একধরণের অত্যাচার চালায়। অথচ মানুষের জীবনে আত্মিক ও মানসিকভাবে পরিতৃপ্ত ও সুখী থাকা অপরিহার্য। আর সেটা কেবল মহান আল্লাহ, তাঁর ফেরেশতাগণ, আসমানী কিতাব সমূহ, নবী-রাসুলগণ, পরকাল ও জীবনের ভাল-মন্দ, স্বাদ-বিস্বাদ সবকিছুর নির্ধারণ কেবল আল্লাহর পক্ষ হতে- এই মর্মে ঈমান আনা এবং আল্লাহর সাথে গভীর সম্পর্ক স্থাপন করা ও তাঁর সার্বক্ষণিক স্মরণ ছাড়া অর্জন সম্ভব নয়।

সারকথা হলো, বহু লোক অন্তরের চিকিৎসা এবং আত্মার প্রশান্তির উপকরণ ও দুনিয়ার ঝড়-ঝঞ্ঝার ভেতরও এক অদৃশ্য জান্নাত সম্পর্কে উদাসীন। ফলে সে কখনোই কাঙ্খিত লক্ষ্য অর্জন করতে পারে না, জীবনের প্রথম থেকেই দেখা পায় না প্রশান্তির কোন লেশ।

আল্লাহর প্রতি ঈমান আনা ছাড়া আত্মার প্রশান্তি ও পরিতৃপ্তি ক্স্মিনকালেও অর্জিত হবে না। কেননা রূহ দিয়েছেন আল্লাহ তা'আলা, আর দেহকে তিনি সৃষ্টি করেছেন মাটি দ্বারা। আত্মা যত বেশি তৃপ্ত থাকবে, আপনি মানসিকভাবে তত উঁচু চিন্তার অধিকারী হবেন এবং তুচ্ছ ও মন্দ কর্মকাণ্ডের উর্ধে উঠতে সক্ষম হবেন। এর বিপরীতে যখনই আপনার আত্মিক দিকটা দূর্বল থাকবে, সাথে সাথে মানসিকতা নিম্নগামী হয়ে পাশবিকতা ও ভোগবিলাসিতার পিছনে অন্ধ হয়ে যাবেন আপনি। আর তাতে গোটা জীবন হয়ে উঠবে সংকীর্ণ ও আড়ষ্ঠ এবং দুচোখে কেবল জগৎটাকে অন্ধকার মনে হবে।



Tags: