সৃষ্টি জগতে আল্লাহর নামসমূহের প্রভাব

সৃষ্টি জগতে আল্লাহর নামসমূহের প্রভাব

খ. সৃষ্টি জগতে আল্লাহর নামসমূহের প্রভাব:

আল্লাহর 'আসমাউল হুসনা' বা সুন্দর নামসমূহ ও সুউচ্চ গুণসমূহের জ্ঞানার্জন করা মহোত্তম ও শ্রেষ্ঠতম জ্ঞানের অংশ। আল্লাহর প্রত্যেক নামের বিশেষ বৈশিষ্ট্য রয়েছে। তাঁর নামসমূহে প্রশংসা ও পূর্ণতার গুণ রয়েছে। প্রত্যেক সিফাতের নিজস্ব দাবীও রয়েছে। প্রত্যেক কর্মের ক্রিয়া রয়েছে, যা কর্মের অপরিহার্য অংশ। আল্লাহর সত্তা তাঁর নাম থেকে, আর নাম গুণাবলী ও এর অর্থ থেকে, তাঁর গুণাবলী আনুষঙ্গিক কর্ম থেকে এবং তাঁর কর্ম অত্যাবশ্যকীয় প্রভাব থেকে বিচ্ছিন্ন হয় না। এ সবকিছুই তাঁর নাম ও গুণাবলীর প্রভাব।

আল্লাহর কর্মসমূহ প্রজ্ঞাময় ও কল্যাণজনক। তাঁর নামসমূহ সুন্দর। সুতরাং এগুলোর নিজস্ব কোন ক্রিয়া থাকবে না- এমনটি মনে করা অবাস্তব ও অযৌক্তিক। একারণে যারা আল্লাহকে আদেশ, নিষেধ, সওয়াব ও শাস্তি প্রদান থেকে নিষ্ক্রিয় সাব্যস্ত করে, আল্লাহ তাদেরকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। এরা আল্লাহর জন্য এমন কিছু বিষয় সাব্যস্ত করেছে যা তাঁর জন্য যথার্থ নয়। তিনি এসকল বিষয় থেকে পবিত্র। এমন সাব্যস্তকরণ একটি গর্হিত কাজ। যারা এমন কিছু সাব্যস্ত করেছে তারা আল্লাহর সম্মান যাথাযথ নিরূপণ করতে পারেনি। তাঁর মর্যাদা যথাযথ অনুধাবন করতে পারেনি। যেমনটি নবুওয়াত, রাসূল প্রেরণ ও কোরআন অবতরণকে যারা অস্বীকার করে তাদের সম্পর্কে আল্লাহ বলেছেন: {তারা আল্লাহকে যথার্থ মূল্যায়ন করতে পারেনি, যখন তারা বলল: আল্লাহ কোন মানুষের প্রতি কোন কিছু অবতীর্ণ করেননি।}
[সূরা: আল-আন’আম, আয়াত: ৯১]

পূণর্জীবন, সাওয়াব ও শাস্তিকে যারা অস্বীকার করে তাদের সম্পর্কে আল্লাহ বলেছেন: {তারা আল্লাহকে যথার্থরূপে বোঝেনি। কেয়ামতের দিন গোটা পৃথিবী থাকবে তাঁর হাতের মুঠোতে এবং আসমান সমূহ ভাঁজ করা অবস্থায় থাকবে তাঁর ডান হাতে।}[সূরা: যুমার, আয়াত: ৬৭।]

আর যে আল্লাহর ব্যাপারে উক্তি করে যে, 'আল্লাহ পরস্পর বিপরীতমুখী দুই ব্যক্তি যথা পাপী ও পূর্ণবান, মুমিন ও কাফেরের সাথে একই আচরণ করবেন'- তাদের সম্পর্কে তিনি বলেছেন:

{যারা দুস্কর্ম উপার্জন করেছে তারা কি মনে করে যে, আমি তাদেরকে সে লোকদের মত করে দেব, যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে এবং তাদের জীবন ও মুত্যু কি সমান হবে? তাদের দাবী কত মন্দ।}[সূরা: আল-জাছিয়া, আয়াত: ২১]

তিনি জানিয়েছেন, এটা মন্দ দাবী যা তাঁর শানে বেমানান। এমন দাবী আল্লাহর নাম ও গুণাবলীকে প্রত্যাখ্যান করার নামান্তর:

আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন: {তোমরা কি ধারণা কর যে, আমি তোমাদেরকে অনর্থক সৃষ্টি করেছি এবং তোমরা আমার কাছে ফিরে আসবে না?, অতএব শীর্ষ মহিমায় আল্লাহ, তিনি সত্যিকার মালিক, তিনি ব্যতীত কোন মাবুদ নেই। তিনি সম্মানিত আরশের মালিক।}
[সূরা: আল-মু’মিনূন, আয়াত: ১১৫- ১১৬]

আল্লাহর নাম ও গুনাবলী যেসব বিষয়কে খণ্ডন করে, সেরকম যেকোন ধারণা ও ভাবনা থেকে তিনি অনেক ঊর্ধ্বে।

এর দৃষ্টান্ত কুরআনে অনেক রয়েছে। যেখানে আল্লাহ তা'আলা নিজ নাম ও গুণাবলীর তাৎপর্যের বিপরীত দাবীকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। কারণ এ জাতীয় দাবী আল্লাহর নিষ্কর্মতা প্রমাণ করে।

সুতরাং আল্লাহ তা'আলার নাম আল-হামিদ, আল-মাজীদ (প্রশংসনীয়, গৌরবময়) এর দাবি হলো: মানুষকে নিরর্থক, অকেজো ও বৃথা ছেড়ে না দেয়া। বরং সে আদেশ নিষেধ প্রাপ্ত হবে এবং পুরস্কার ও শাস্তির সম্মুখীন হবে। তদ্রুপ তাঁর নাম আল হাকীম (প্রজ্ঞাময়) এর দাবীও এটাই। একই কথা তাঁর অপর নাম আল মালিক (অধিপতি) প্রসঙ্গেও প্রযোজ্য।

আল্লাহর নাম আল-হাই (চিরঞ্জীব) এর দাবী হলো: আল্লাহ নিষ্ক্রিয় নন। জীবিত হওয়া প্রমাণ করে যে তিনি কর্মমুখর। প্রতিটি জীব কর্মসম্পদন করে। এটা তাঁর স্রষ্টা হওয়া ও স্থায়ী হওয়াকেও প্রমাণ করে। আল্লাহর নাম 'আস-সামী ও আল-বাছীর'-এর দাবী হলো: তিনি সবকিছু শুনেন এবং দেখেন। তাঁর 'আল-খালিক' নামটি প্রমাণ করে যে সবকিছুই তাঁর সৃষ্ট। 'আর-রাজ্জাক' নামটিও এ বিষয়টি প্রমাণ করে। আল্লাহর 'আল-মালিক' নাম তাঁর রাজত্ব, পরিচালনা, দেয়া না দেয়া, দয়া করা, ইনসাফ কায়েম করা, সাওয়াব ও শাস্তি দেয়া তাঁর হস্তগত এ বিষয়টি প্রমাণ করে। তাঁর নাম 'আল-বার, আল-মুহসিন, আল-মু’তী, আল-মান্নান'ও সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তাঁর কর্ম ও প্রভাব প্রমাণ করে।

'আল-গাফফার, আত-তাউয়াব, আল-আফউ' (পরম ক্ষমাশীল, তওবার তৌফিকদাতা, ক্ষমাপরায়ণ) নামসমূহে অনিবার্য ভাবেই সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি রয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে অপরাধ ক্ষমা করা, তওবা কবুল করা, মার্জনা করা ইত্যাদি। তাঁর নাম 'আল-হাকীম' তিনি সর্ব বিষয়ের নির্দেশদাতা হওয়ার বিষয়টি প্রমাণ করে। এই নামগুলোর তেমনই দাবি ও প্রভাব রয়েছে যেমন আল-খালিক, আল-রাজ্জাক, আল-মুতী’, আল-মামনু' ইত্যাদি নামের রয়েছে। এই সব নামই সুন্দরতম।

মহান প্রতিপালক আপন সত্তা, গুণাবলী ও নামসমূহকে ভালবাসেন। তিনি ক্ষমাশীল, মার্জনা ও ক্ষমাকে ভালবাসেন। বান্দা যখন আল্লাহর কাছে তওবা করে তিনি অত্যন্ত খুশী হন। তার প্রতি দয়ার্দ্র আচরণ করেন, তার তওবা কবুল করেন, তার গুনাহ মার্জনা করেন।

আল্লাহ তা'আলা আল-হামীদ, আল-মাজীদ (প্রশংসিত, গৌরবময়)। আর স্বাভাবিকভাবেই তাঁর প্রশংসা ও গৌরব এ দুই গুণেরও প্রভাব- প্রতিক্রিয়া রয়েছে। এ দুই গুণের প্রতিক্রিয়া হচ্ছে, গুনাহ মাফ করা, স্খলন থেকে নিষ্কৃতি দেয়া, অপরাধ মার্জনা করা ও পাপ থেকে মুক্তি দেয়া। তিনি হক আদায় করতে পূর্ণ সক্ষম। তিনি মানুষের অপরাধ ও শাস্তির পরিমাণ জানেন। জানার পরও তিনি সহনশীলতা প্রদর্শন করেন। শাস্তি দিতে সক্ষম হয়েও তিনি ক্ষমা করেন। তাঁর সম্মানের পূর্ণতা ও প্রজ্ঞার কারণেই তিনি ক্ষমা করেন। যেমনটি ঈসা আ.-এর কণ্ঠে আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেছেন: {যদি আপনি তাদেরকে শাস্তি দেন, তবে তারা আপনার দাস এবং যদি আপনি তাদেরকে ক্ষমা করেন, তবে আপনিই পরাক্রান্ত, মহাবিজ্ঞ।}
[সূরা: আল মায়িদাহ, আয়াত: ১১৮।]

অর্থাৎ আপনার ক্ষমা যা পূর্ণ ক্ষমতা এবং প্রাজ্ঞতা প্রসূত হয়ে থাকে। আপনি তার মত নন যে অপারগ হয়ে ক্ষমা করে আর অজ্ঞতাহেতু দয়া করে। বরং আপনি আপনার হক সম্পর্কে পরিপূর্ণ জ্ঞাত, তা আদায় করতে পূর্ণ সক্ষম এবং তা গ্রহণের ব্যাপারে বিজ্ঞ।

সুতরাং যে ব্যক্তি বিশ্বময় আল্লাহর নামের প্রভাব-বৈশিষ্ট্য নিয়ে চিন্তাভাবনা করে, তার নিকট সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে-বান্দার কৃত অপরাধসমূহ ও তার ফলে প্রদত্ত শাস্তি আল্লাহর নাম-গুন ও কর্মের পূর্ণতারই অংশ। আর এসব নাম ও গুন সর্বদাই তাঁর প্রশংসা ও মহত্বের দাবি রাখে।

সুতরাং তিনি যা নির্ধারণ এবং ফয়সালা করেন তা পূর্ণ প্রাজ্ঞতা থেকে ও সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলীর আলোকেই করে থাকেন। যেমন বান্দাদেরকে তাঁর নাম ও গুণাবলীর সঙ্গে পরিচিত করা, তাঁকে মুহব্বত করা, তাঁকে স্মরণ করা, এবং তাঁর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা। তিনি সব কিছুর ফায়সালা ও নির্ধারণের আরেকটি উদ্দেশ্য হলো, বান্দা যেন আল্লাহর গুনবাচক নাম সমূহের প্রতি প্রশ্নাতীত বিশ্বাস স্থাপন করতে পারে। কেননা সব নামই প্রশ্নাতীত। আর আল্লাহর পরিপূর্ণ বান্দা হলো সে, যে ব্যক্তি (আল্লাহর) সমস্ত নাম ও গুণাবলীর আলোকে তাঁর উপাসনা করে।

আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেছেন: {আর আল্লাহর জন্য রয়েছে সব উত্তম নাম। কাজেই সে নাম ধরেই তাঁকে ডাক।}
[সূরা: আল-আ’রাফ, আয়াত: ১৮০।]

সুন্দরতম নাম নিয়ে দোয়া করার উদ্দেশ্য হলো, প্রয়োজন, প্রশংসা ও উপসনাকে কেন্দ্র করে তাঁকে ডাকা। তিনি এমন সত্তা যিনি তাঁর বান্দাদেরকে তাঁর নাম এবং গুণাবলী সম্পর্কে পরিচিত হওয়ার প্রতি আহ্বান করেন এবং এসব নাম ও গুনাবলীর দ্বারা যেন তারা তাঁর প্রসংশা করে।

তিনি এমন পবিত্র সত্তা যিনি তাঁর নাম ও গুণাবলীর সারমর্ম ও যার মধ্যে তা পাওয়া যাবে, তাকে ভালবাসেন। যেমন: তিনি জ্ঞানী, তিনি প্রত্যেক জ্ঞানীকে ভালবাসেন। তিনি দানশীল, সকল দানশীলকে ভালবাসেন। তিনি বেজোড় এবং বেজোড়কে পছন্দ করেন। তিনি সুন্দর, সুন্দরকে ভালবাসেন; মার্জনাকারী, মার্জনা এবং এ গুণের অধিকারীকে ভালবাসেন। লজ্জাশীল , লজ্জা ও এই গুণের অধিকারীকে ভালবাসেন; কল্যাণকামী, তিনি কল্যাণকামীকে ভালবাসেন; কৃতজ্ঞশীল, তিনি কৃতজ্ঞশীলকে ভালবাসেন; তিনি ধৈর্যশীল, ধৈর্যশীলকে ভালবাসেন। তাওবা, ক্ষমা, মার্জনা গুণের অধিকারীকে এবং যে অন্যের ভুলবিচ্যুতি উপেক্ষা করে তাকে তিনি ভালবাসেন, তিনি তাকে ক্ষমা করেন এবং তার তাওবা কবুল করেন। তাকে মার্জনা করেন এবং তার (ভুল) উপেক্ষা করেন।

তিনি সৃষ্টির কোন জিনিসের সাদৃশ্য গ্রহণ করেন নি, আর সৃষ্টির কোনকিছুও তাঁর সাদৃশ্য নয়। তিনি তাঁর নাম এবং গুণাবলীসহ সর্বদা ছিলেন এবং থাকবেন।

-ইমাম আবু হানীফা।



Tags: